ব্রেক্সিট নিয়ে বিষিয়ে উঠেছে যুক্তরাজ্যের রাজনীতি

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বিচ্ছেদ-পরবর্তী সম্পর্ক নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কাছে যে চূড়ান্ত প্রস্তাব তুলে ধরেছেন, সেটিকে ‘সুইসাইড ভেস্ট’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন সদ্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে গত জুলাই মাসে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের ব্রেক্সিটপন্থী এই রাজনীতিক।

ক্ষমতাসীন দলে কট্টর ব্রেক্সিটপন্থীদের প্রকাশ্য নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমপি জ্যাকব রিচ মগ। কয়েক দিন আগে তাঁর বাসার সামনে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের সমর্থকেরা বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভকারীরা জ্যাকবের ছোট্ট শিশুদের সামনে পেয়ে বলেন, ‘তোমরা কি জানো, তোমাদের বাবা ভীষণ বাজে লোক?’

বিরোধী দল লেবার পার্টিতে দলনেতা জেরেমি করবিনের ‘মোমেন্টাম’ নামে আলাদা একটি সমর্থকগোষ্ঠী আছে। ব্রেক্সিটসহ বিভিন্ন ইস্যুতে করবিনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ করেন-এমন এমপিদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আসনের মোমেন্টাম সদস্যরা অনাস্থা ভোটের আয়োজন করছেন বলে অভিযোগ। যাতে ওই সব এমপিকে আগামী নির্বাচনে সরাসরি মনোনয়ন না পেয়ে নতুন করে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে আসতে হয়। এতে বেজায় চটেছেন ব্রেক্সিটবিরোধী হিসেবে পরিচিত লেবার দলের প্রভাবশালী এমপি চুকা উমুন্না। গত সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলন করে তিনি জেরেমি করবিনের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনার কুকুরদের সামলান।’

ওপরের তিনটি ঘটনা বলে দিচ্ছে ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ (ব্রেক্সিট নামে পরিচিত) কার্যকর করা নিয়ে কতটা অন্তঃকলহে লিপ্ত ব্রিটিশ রাজনীতিকেরা। রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা প্রশ্ন তুলেছেন-সভ্য, উদার গণতান্ত্রিক দেশটির রাজনীতি এতটা বিষাক্ত কী করে হলো? মতপার্থক্যের চাইতে রাজনীতিকদের ভাষা নিয়ে তাঁদের আপত্তি বেশি।

২০১৬ সালে এক গণভোটে যুক্তরাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার ইইউ ত্যাগ করার পক্ষে রায় দেয়। মূলত জোটভুক্ত অন্য দেশগুলো থেকে অভিবাসীদের অবাধ প্রবেশ ঠেকাতে তারা এমন সিদ্ধান্ত দেয়। সেই রায়ের বাস্তবায়ন নিয়ে প্রায় দুই বছর ধরে চলছে আলোচনা। কিন্তু বিচ্ছেদের পর ইইউর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য সম্পর্ক কী হবে এবং যুক্তরাজ্যের অংশ নর্দান আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে স্বাধীন আয়ারল্যান্ডের উন্মুক্ত সীমান্ত চুক্তি রক্ষার বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি তারা। তবে ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ রাত ১১টায় ব্রেক্সিট কার্যকর হবে বলে দিনক্ষণ ঠিক করা আছে। সে অনুযায়ী আসছে অক্টোবরের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদনের প্রত্যাশা করা হচ্ছিল। কিন্তু আলোচনা এক কদম আগায় তো তিন কদম পিছিয়ে যায়, এভাবেই চলছে।

সর্বশেষ গত শুক্রবার যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিটবিষয়ক মন্ত্রী ডোমিনিক রাব এবং ইইউর পক্ষে প্রধান সমঝোতাকারী মিশেল বার্নিয়ে টেলিফোনে কথা বলেন। এরপর এক বিবৃতিতে ডোমিনিক দাবি করেন, চুক্তির দিকে আলোচনা এগিয়ে গেছে। আয়ারল্যান্ড সীমান্ত নিয়ে ইতিবাচক আলোচনার ইঙ্গিত দেন তিনি। তাঁর এ কথায় বিস্ময় প্রকাশ করেন ইইউ কূটনীতিকেরা। মিশেল বার্নিয়ে টুইট করে জানিয়ে দেন, আয়ারল্যান্ড সীমান্ত এখনো বড় বাধা। ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনাও বেশ বাকি।

সমস্যা সমাধানে নর্দান আয়ারল্যান্ডকে ইইউর ‘সিঙ্গেল মার্কেট’ এবং ‘কাস্টমস ইউনিয়ন’-এর অধীনে রেখে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল ইইউ। যুক্তরাজ্য তা প্রত্যাখ্যান করে। প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এ বিষয়ে কার্যকর বিকল্প উপস্থাপন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তা এখনো করতে পারেননি বলে দাবি ব্রাসেলসের।

বিচ্ছেদের ক্ষণ ঘনিয়ে আসায় এখন চুক্তির চাইতে চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বেশি। কেননা, মতপার্থক্য নিরসনের সময় আর বেশি নেই। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ কলহের কারণে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে নতুন করে আর ছাড় দিতে পারবেন না। আর প্রধানমন্ত্রীর ‘চেকার্স ডিল’ (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কান্ট্রিহাউস চেকার্সে নেওয়া সর্বশেষ সিদ্ধান্ত) মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন ইইউ নেতারা।

এমন পরিস্থিতিতে চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিটের বিষয়ে যুক্তরাজ্য সরকার বারবার নিজেদের প্রস্তুতির কথা জানান দিচ্ছে। সরকার বলছে, তারা একটি সফল চুক্তি চায়। তবে কোনো খারাপ চুক্তির চেয়ে চুক্তিহীন বিচ্ছেদকেই বেছে নেবে তারা। চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট হলে জনগণ অসুবিধার ‍মুখে পড়তে পারেন-এমন আরও ৫০টি বিষয়ে গত বুধবার নির্দেশনা প্রকাশ করে ব্রিটিশ সরকার। এতে বলা হয়েছে, চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিটের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ নাগরিকেরা ইইউভুক্ত দেশে গেলে মোবাইলের রোমিং চার্জ দিতে হতে পারে। তাদের বিদ্যমান ড্রাইভিং লাইসেন্স ইইউতে কার্যকর না-ও থাকতে পারে। ইইউর সঙ্গে ট্রেন ও বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সীমান্তে আটকে যেতে পারে মালবাহী যান। এতে দ্রব্যমূল্য বাড়তে পারে। এমন আরও অনেক কিছু ঘটতে পারে। এসব সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতির কথা তুলে ধরার পাশাপাশি জনগণকে মানসিক প্রস্তুতি রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর মার্ক কার্নি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিটের পরিণতি হতে পারে ২০০৮ সালে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দার মতো। বাড়িঘরের দাম ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে বলে তাঁর আশঙ্কা।

এতসব সতর্কতার ভিড়ে ব্রেক্সিট বিষয়ে পুনরায় গণভোটের দাবি আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। গত শনিবার লন্ডনের মেয়র সাদিক খানও একই দাবি তুলেছেন। ব্রেক্সিটবিরোধীরা বলছেন, চুক্তি গ্রহণ বা বর্জন বিষয়ে আবার গণভোট করতে হবে, যাতে ক্ষতিকর চুক্তি বর্জনের সুযোগ পায় জনগণ।

প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে তাঁর চেকার্স ডিলের প্রতি সমর্থন আদায়ের অব্যাহত চেষ্টার অংশ হিসেবে আগামী বুধবার অস্ট্রিয়ায় ইইউ নেতাদের একটি অনানুষ্ঠানিক সম্মেলনে যোগ দেবেন। এমন তৎপরতার পাশাপাশি তিনি এ-ও বলছেন, বিচ্ছেদের অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্য যে ৩৯ বিলিয়ন পাউন্ড পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, চুক্তি ছাড়া ব্রেক্সিট হলে সেই অর্থ দেওয়া হবে না। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো কিছুই চূড়ান্ত নয়।