আরএসএস-এর রংবদল, পরীক্ষার মুখে মোহন ভাগবত

মোহন ভাগবত
মোহন ভাগবত

ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক উঠে গেল। প্রশ্নও। দক্ষিণপন্থী রাজনীতি কোন মতবাদকে আঁকড়ে ধরবে? গত চার বছর ধরে ‘কংগ্রেসমুক্ত’ ভারত গড়ার যে ডাক দিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর জুড়িদার বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ, নাকি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবতের শোনানো নয়া তত্ত্ব ‘যুক্ত ভারত’ গড়ার আহ্বানকে? গোরক্ষা আন্দোলনের নামে মুসলমান-দলিতদের পিটিয়ে মারা অথবা লাভ জেহাদের মোকাবিলায় কোমর কষে নামার যে সংস্কৃতি বিজেপি রাজনীতিতে ইদানীং প্রাধান্য পাচ্ছে তাকে, নাকি মোহন ভাগবতের বলা এই কথাকে যে, ‘ভারতীয় মুসলমানদের বাদ দিয়ে হিন্দুত্বের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না?’

সন্দেহ নেই, হিন্দুত্বের সংজ্ঞা ও ভবিষ্যৎ ভারত গড়ার ধ্যান ধারণা সম্পর্কে সংঘ প্রধান মোহন ভাগবত দিল্লিতে আরএসএসের তিন দিনের অনুষ্ঠানে যেভাবে নিজের চিন্তা ও ভাবনাকে মেলে ধরলেন তা শাসক দলের কর্ণধারদের নতুন নতুন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবেই। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তা হলে কি এযাবৎ লালিত ‘হিন্দুত্বের’ সংজ্ঞা পরিবর্তনের মাধ্যমে একদা নিষিদ্ধ আরএসএস ও তার পরিবারের বিভিন্ন শাখাকে ‘বহুত্ববাদী’ ভারতীয় সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার নতুন প্রচেষ্টা শুরু করলেন মোহন ভাগবত? উত্তর যাই হোক না কেন, তাঁর মনের কথা মোদি-শাহর বিজেপিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বিতর্কের মুখোমুখি।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শুধু ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গড়ার কথাই বলেননি, চার বছর ধরে কংগ্রেস বিরোধিতার মাত্রা ক্রমেই বাড়িয়ে তুলেছেন। জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে ইন্দিরা-রাজীব ও রাহুল গান্ধীকে ভারতের যাবতীয় অনাসৃষ্টির জন্য তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর কথায়, স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেস দেশকে বরবাদ করেছে। লুটের বহর বইয়ে দিয়েছে। এই কংগ্রেসকে ‘আস্তাকুঁড়ে’ ছুড়ে ফেলে নতুন ভারত গড়তে হবে। এত দিন ধরে শুনিয়ে আসা বিজেপির শীর্ষ নেতাদের এই ধারণাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে মোহন ভাগবত শোনালেন আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমেদের সেই মন্তব্য, যাতে বলা হয়েছিল, ‘মুসলমানেরাও এই দেশের সন্তান। হিন্দুদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য শুধু উপাসনায়।’ শুধু ওই মন্তব্যই নয়, মোহন ভাগবত এক কদম এগিয়ে এ কথাও শুনিয়েছেন, ‘ভারতীয় মুসলমানদের বাদ দিয়ে হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। যাঁরা আমাদের বিরোধিতা করেন, তাঁরাও আমাদেরই অংশ।’

জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার পর দেশের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আরএসএসকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। তার পর সংগঠনকে আরও এক বিরাট ধাক্কা সইতে হয়েছিল ১৯৯২ সালে, সংঘ অনুমোদিত সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ যখন বাবরি মসজিদ ধূলিসাৎ করে। তারা চিরকাল বলে এসেছে, ভারতীয় সংবিধান ‘ভারতীয়ত্ব ও হিন্দুত্বের’ বাণী প্রচার করে না। সেই ধারণার সম্পূর্ণ বদল ঘটিয়ে ভাগবত বলেন, ভারতীয় সংবিধানকে আরএসএস গ্রহণই শুধু করেনি, ভারতের ‘সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রজাতান্ত্রিক’ চরিত্রকেও মেনে নিয়েছে। মোদি-শাহর চোখে ‘ঘৃণ্য অপরাধী’ কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্যতাকে স্বীকৃতি দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে দলটির ভূমিকার উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘বহু মানুষ রয়েছেন যাঁরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। যাঁরা আজও আমাদের উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত করেন। তাঁদের আদর্শই দেশকে স্বাধীনতা পাইয়ে দিয়েছে।’ কংগ্রেসি মতামতকে অগ্রাহ্য করে গত চার বছর ধরে যাঁরা ‘ভারতের নতুন ইতিহাস’ রচনায় আগ্রহী, এই নবরূপী মোহন ভাগবতে তাঁরাও বিস্মিত।

সংঘ চালক বলেছেন, তাঁরা সমাজ পরিবর্তনে আগ্রহী। দৈনন্দিন রাজনীতিতে তাঁদের কোনো আগ্রহই নেই। এ কথাও বলেছেন, সংঘের কাউকে তাঁরা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করার নির্দেশ দেন না। সমাজ পরিবর্তনের জন্য যে কোনো মতবাদের বা গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁরা কাজ করতে উৎসুক। করেনও। প্রশ্ন উঠছে, এত দিন পর কেন এই বিপুল ‘ইউ টার্ন?’ বিশেষ করে সংঘ গুরু গোলওয়ালকরের বই ‘বানচ অব থটস’-কে ‘চিরকালীন’ আখ্যা না দেওয়া? যেখানে গোলওয়ালকর এদেশের মুসলমানদের ‘বহিরাগত’ বলেছিলেন? মোহন ভাগবতের কথায়, ‘কোনো একটা সময় কোনো এক পরিপ্রেক্ষিতে বলা কোনো কথা কিছুতেই চিরন্তন সত্য হয় না। শ্মশান, কবরিস্তান, আতংকবাদের রাজনীতি তারাই করে যাদের একমাত্র লক্ষ ক্ষমতা দখল করা। রাজনীতিটা করা দরকার মানুষের মঙ্গলের জন্য।’

সাধারণ নির্বাচনের আট-নয় মাস আগে সংঘ প্রধান যে নিদান দিলেন তাতে আগামী দিনে বজরঙ্গ দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, হিন্দু সেনার মতো সংঘ পরিবারের অনুগত সৈনিকেরা কি সংযত হবে? এই প্রশ্ন উঠে গেছে। প্রশ্ন উঠেছে, ভাগবত-বাণী শোনার পর ‘ঘর ওয়াপসি’, ‘লাভ জেহাদ’ ও ‘নৈতিক পুলিশদের’ বাড়াবাড়ি কি বন্ধ হবে? গোরক্ষার নামে গণপিটুনির প্রবণতা আর থাকবে না? ধর্মীয় মেরুকরণের যে রাজনীতিতে বিজেপি গা ভাসিয়েছে, মুসলমান বিতাড়নে যেভাবে ‘এনআরসি’কে হাতিয়ার করেছে, তাতে রাশ টানা হবে?

রাজধানীতে আরএসএসের তিন দিনের সমাবেশ শেষে সংঘ প্রধান মোহন ভাগবত নিজেই নিজেকে দাঁড় করালেন মোক্ষম এক পরীক্ষার মুখে। তাঁর বাণী নাকি মোদি-শাহ তত্ত্ব, কোনটা প্রাধান্য পায় সেটাই এখন দেখার।