গলফ পার্টনার শিনজো আবেকে ছাড় দিচ্ছেন ট্রাম্প?

অন্যায্য বাণিজ্যনীতির বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারের সময়ই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ক্ষমতায় বসার প্রথম দিন থেকে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। মেক্সিকো-কানাডা-আমেরিকার মধ্যকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। প্রতিবেশী কানাডার ইস্পাতসহ বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক আরোপ করতেও পিছপা হননি তিনি। ইউরোপকেও সাফ জানিয়েছেন (ন্যাটোর মাধ্যমে), নিরাপত্তা চাইলে প্রতিরক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আর চীনের ওপর শুল্ক খড়্গে তো বাণিজ্যযুদ্ধই শুরু হয়ে গেছে।

এ পরিস্থিতিতে চুপ করে ছিল জাপান। প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের গলফ পার্টনার ট্রাম্প হয়তো তাঁর রোষানল থেকে জাপানকে সরিয়ে রাখছেন—এমনটি আশা করছিল দেশটি। তবে সুখ বোধ হয় বেশি দিন সইছে না জাপানের। দেশটি আশঙ্কা করছে, এবার তাদের গাড়ির বাজারে উচ্চ শুল্ক বসাতে যাচ্ছেন ট্রাম্প। এ বিষয়ে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করবে জাপান।

আসলে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও জাপানের সঙ্গে বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি থাকায় বেশ বিরক্ত ট্রাম্প। সম্প্রতি গণমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই বিরক্তি প্রকাশ করেন তিনি। অবশ্য তার আগে জাপানের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের কথাও তুলে ধরেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আমি তাদের বলব যে কত মূল্য দিয়ে এটা শেষ করতে হবে।’

গত বছর জাপানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি সবচেয়ে বেশি চীনের সঙ্গে (৩৭৫ বিলিয়ন), এরপরই রয়েছে মেক্সিকো (৭১ বিলিয়ন), তারপরই জাপান। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন ডলার। বাণিজ্য ঘাটতির ৮০ শতাংশ হচ্ছে গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ রপ্তানির মাধ্যমে। লাখ লাখ জাপানিজ গাড়ি চলছে যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায়, পক্ষান্তরে অল্প কিছু ব্র্যান্ডের গাড়ি যুক্তরাষ্ট্র থেকে যাচ্ছে জাপানে। আর যা ট্রাম্পের মূল মাথাব্যথার কারণ, জাপান থেকে গাড়ি আমদানিতে কোনো শুল্ক নেই। কেবল আড়াই শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বড় আকারের হওয়ায় ও গ্রাহকের রুচি অনুযায়ী জাপানের রাস্তায় যুক্তরাষ্ট্রের গাড়িগুলো খুব বেশি যথোপযুক্ত নয়।

বার্তা সংস্থা এএফপি ও জাপান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাণিজ্য ঘাটতি ও শুল্ক আরোপের বিষয় নিয়ে ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের বাণিজ্য প্রতিনিধিতে আলোচনা হয়েছে। দুই পক্ষই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে। ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপের মতো কোনো বহুজাতিক বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তি করতে চায় টোকিও। অপরদিকে ওয়াশিংটন শুধু দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে বিশ্বাসী। টোকিও জানিয়েছে, তাঁরা তখনই দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে যাবে, যখন তাঁদের গাড়িশিল্পে বাড়তি শুল্ক আরোপ থেকে বিরত থাকবে যুক্তরাষ্ট্র।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চীন ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (নাফটা) নিয়ে কিছু নিষ্পত্তিতে পৌঁছানোর পর ডোনাল্ড ট্রাম্প জাপানের দিকে মনোযোগী হবেন, তার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এতে কার বেশি ক্ষতি হবে? জাপানের সঙ্গে আলোচনায় ট্রাম্প প্রশাসনের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হলো জাতীয় নিরাপত্তার কথা তুলে গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি—এমনটাই মনে করছেন প্রযুক্তি নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান টেকনো ইনটেলিজেন্সের টোবায়াস হ্যারিস। তিনি বলেন, এই ধরনের পদক্ষেপ জাপানের অর্থনীতিতে ‘উল্লেখযোগ্য’ প্রভাব ফেলবে।

কেমন করে? জায়ান্ট গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টয়োটা ও নিশান প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ গাড়ি বিক্রি করে। এসব গাড়ির বেশির ভাগই জাপান, মেক্সিকো ও কানাডায় তৈরি হয়। জাপানের অর্থনীতিবিদ হারুমি তাগুচি মনে করছেন, ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হলে তা জাপানের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমাবে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। উৎপাদনকারীরা ইতিমধ্যে জানিয়েছে, এই বাড়তি ব্যয় তাদের ওপর চাপ ফেলবে। এর ফলে পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হবে তারা। টয়োটার ক্ষেত্রে প্রতি গাড়িতে দাম বাড়বে কমপক্ষে ৬ হাজার ডলার। জাপানের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবছর ৪০ লাখ গাড়ি তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। প্রায় ১৫ লাখ মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

চীনের মতো ‘ইটটি মারলে পাটকেল খেতে হবে’ এমন হুমকি না দিলেও প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে মনে করেন এ ধরনের সিদ্ধান্ত কারও জন্যই সুফল বয়ে আনবে না। এ বিষয়ে জাপান সম্ভবত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে আবেদন করবে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র যখন ইউরোপের ইস্পাত আমদানিতে শুল্ক আরোপ করেছিল, তখন বিশ্ব অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়েছিল।

এমন অবস্থায় ট্রাম্পের রোষানলে না পড়তে কী করতে পারেন আবে। তাগুচি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে শেল গ্যাস, মিলিটারি পণ্য আমদানি বাড়িয়ে দিতে পারে জাপান। এ ছাড়া দেশীয় উৎপাদনে বাধা ফেলবে না, এমন পণ্য উৎপাদন বাড়িয়ে দিতে পারে তারা। জাপান ইতিমধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র কেনার ঘোষণা দিয়েছে। তাগুচি মনে করেন, জাপান যদি কৃষি ও বিভিন্ন খাতে সন্তোষজনক প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারে, তাহলে হয়তো এই শুল্কের খড়্গ থেকে মুক্তি পেতে পারে জাপান। তবে এটা এখন জাপানের জন্যও স্পর্শকাতর। কারণ ইতিমধ্যে নিজের দেশে কৃষিকে সুরক্ষা দিতে শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁরা।

এ ছাড়া আরও একটি উপায় খোলা আছে জাপানের জন্য। গণমাধ্যম সিএনবিসির এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরোপে জাপানের পণ্য রপ্তানি এ বছর বেশ বেড়েছে। চলতি বছরের প্রথম অর্ধেকে ইউরোপে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ শতাংশ। ২০১৭ সাল থেকেই এ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এ ছাড়া এশিয়া হতে পারে জাপানের জন্য সবচেয়ে ভালো বিকল্প। গত বছর চীনে জাপানের বিক্রি বেড়েছে সাড়ে ২০ শতাংশ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংগঠন আসিয়ান দেশগুলোতে যা ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে এই বাজারে জাপানের রপ্তানি বৃদ্ধির হার কিছুটা কমলেও খুব বেশি হতাশাজনক নয়। এসব অঞ্চলে জাপানের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আছে ৯ থেকে ১১ শতাংশ।

যদিও চীনের সঙ্গে বাণিজ্যে একটা সূক্ষ্ম সমস্যা রয়েছে। আগামী মাসে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বৈঠকে চীনের আস্থা পেতে আবেকে কঠিন কাজ করতে হবে। অবশ্য গত ছয় বছরে আবে একটি পর্যায়ে গেছেন, কারণ তিনি জানেন যে চীন জাপানের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাজার।