অমিত শাহর 'উইপোকা' মন্তব্য অশোভন ও অবাঞ্ছিত

বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ। ছবি: রয়টার্স
বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ। ছবি: রয়টার্স

ভারতের শাসক দল বিজেপির সভাপতি অমিত শাহর ‘উইপোকা’ মন্তব্য শুধু ‘অশালীনই নয়, অবাঞ্ছিত, অপ্রয়োজনীয় ও দুর্ভাগ্যজনক’। ভারতের সাবেক কূটনীতিকদের কেউ কেউ তো বটেই, পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞ ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের অনেকের অভিমত এমনই। তাঁরা মনে করেন, এই ধরনের মন্তব্য বাংলাদেশ ও ভারতের সুসম্পর্ককে বিষিয়ে দিতে পারে। ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করতে পারে।

অমিত শাহ সম্প্রতি রাজস্থান ও দিল্লিতে দুটি জনসভায় ভারতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারীদের ‘উইপোকা’র সঙ্গে তুলনা করেন।

আসামে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) তৈরি প্রসঙ্গে এই মন্তব্য করে অমিত শাহ বলেন, অনুপ্রবেশকারীরা প্রকৃত ভারতীয়দের অধিকার হরণ করছে। রসদে ভাগ বসাচ্ছে। উইপোকার মতো ভেতর থেকে দেশকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ওদের প্রত্যেককে খুঁজে বের করা হবে। তারপর ফেরত পাঠানো হবে।

গত রোববার দিল্লিতে রামলীলা ময়দানের জনসভায় অমিত শাহর উপস্থিতিতে দলের অন্য নেতারা অনুপ্রবেশকারীদের ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, প্রত্যেককে সে দেশে ফেরত পাঠানো হবে।

এই ধরনের মন্তব্য বাংলাদেশ ও ভারত—দুই দেশের পক্ষেই ক্ষতিকর বলে মনে করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার ও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মুচকুন্দ দুবে। অমিত শাহর মন্তব্য প্রসঙ্গে গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এই উপমহাদেশে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো। এই ধরনের মন্তব্য সেই সম্পর্ক বিষিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।’

মুচকুন্দ দুবে বলেন, ‘অনুপ্রবেশকারীদের উইপোকার সঙ্গে তুলনা করা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। তেমনই বিস্ময়কর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা। আমার মনে হয়, এটা একটা অদ্ভুত কৌশল। প্রধানমন্ত্রী মৌন থাকবেন, অন্যরা যা খুশি তা বলে যাবেন।’

‘উইপোকা’ মন্তব্যকে অযাচিত ও অশোভন বলে বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত আরেক সাবেক হাইকমিশনার দেব মুখোপাধ্যায়। গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কোনো বন্ধু দেশের পক্ষে এমন মন্তব্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’

দেব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘এটা ঠিক, কথাটা দলের পক্ষ থেকে এসেছে, সরকারের পক্ষ থেকে নয়। কিন্তু সরকারের উচিত এমন ধরনের অবাঞ্ছিত ও অশোভন মন্তব্যের রাশ টেনে ধরা। দুঃখের কথা, সরকারের সেই ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না।’

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য তৃণমূল কংগ্রেসের অর্পিতা ঘোষ ও সিপিএমের মহম্মদ সেলিম মনে করেন, এনআরসিকে কেন্দ্র করে বিজেপি ও কেন্দ্রীয় সরকার যা করছে, তা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একমাত্র বন্ধু দেশকেও বৈরী করে তুলবে।

প্রথম আলোকে সেলিম বলেন, ‘দেশের শাসক দলের সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য সংসদীয় ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আগে দেখা যায়নি। বিজেপি দলটার মানসিকতাই বিকৃত। ধর্মীয় অনুভূতিতে উসকানি দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়াই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। হিন্দি, হিন্দু ও হিন্দুস্তানই তাদের ধ্যানজ্ঞান। অথচ ভারত যে বহুত্ববাদী, তা তারা বুঝতে চায় না।’

অর্পিতা বিজেপি-শাসনাধীন এই সময়ের ভারতকে জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস ‘নাইন্টিন এইট্টিফোর’-এর সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের স্বরূপ যে কী ভয়ংকর, বিজেপি তা দেখিয়ে দিতে চায়। কিন্তু তাদের মনে রাখা দরকার, ভয় ও ঘৃণা দিয়ে না করা যায় দেশ শাসন, না আদায় করা যায় বন্ধুত্ব।’

তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার নেতা সুখেন্দু শেখর রায় উদ্বিগ্ন দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক দেশের সাম্প্রতিক ভারতবিরোধী মনোভাব নিয়ে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এই উপমহাদেশে চীনের প্রভাব ক্রমে বাড়ছে। বন্ধু দেশগুলো একে একে দূরে সরে যাচ্ছে। একমাত্র দৃঢ়ভাবে টিকে রয়েছে বাংলাদেশ। নিছক ভোটে জেতার জন্য এই উইপোকা–জাতীয় মন্তব্য বাংলাদেশকেও বিরূপ করে দেবে। বাংলাদেশ বিরূপ হলে সবচেয়ে ক্ষতি হবে পশ্চিমবঙ্গের।’

সুখেন্দু শেখর রায় বলেন, ‘আমার অবাক লাগে এটা দেখে যে সরকার দলকে নিয়ন্ত্রণ করছে না। এর মানে এই ধরনের মন্তব্যে সরকারের সায় রয়েছে।’

ভোট-আবহে এই ধরনের মন্তব্যকে বাংলাদেশে নিযুক্ত আরেক সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি অবশ্য বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাইছেন না। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এনআরসি নিয়ে আসামের সব দলের সমর্থন রয়েছে। তা ছাড়া এটা তৈরি করা হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে ভারতের শীর্ষ নেতৃত্ব বিষয়টি বুঝিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে। তবু বিরোধ বা ভুল বোঝাবুঝি কোনো আশঙ্কা দেখা দিলে দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব নিশ্চিতই দ্বিপক্ষীয় স্তরে আলোচনার মাধ্যমে তার মীমাংসা করবে।’

অমিত শাহর মন্তব্যকে ‘চূড়ান্ত রকমের অবাঞ্ছিত ও অপ্রয়োজনীয়’ বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও ভারতের ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের (আইডিএসএ) কর্মসমিতির সদস্য অধ্যাপক এস ডি মুনি। গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত মাত্র কদিন আগেই যুক্ত ভারত গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন। মুক্ত ভারত নয়, বিজেপি ও আরএসএসের মধ্যে মুক্ত ও যুক্ত নিয়ে যে বিরোধ দেখা দিয়েছে, সময় এসেছে সেই মতানৈক্য দূর করার।’