সৌদি যুবরাজের খেলায় রেফারি কে?

সৌদি আরবের ভিন্নমতাবলম্বী প্রতিবাদী সাংবাদিক জামাল খাসোগি উধাও হয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে ওয়াশিংটনে বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি
সৌদি আরবের ভিন্নমতাবলম্বী প্রতিবাদী সাংবাদিক জামাল খাসোগি উধাও হয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে ওয়াশিংটনে বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি

সৌদি আরবের প্রতিবাদী সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে নিয়ে যেন চলছে লুকোচুরি খেলা। খেলোয়াড় মূলত সৌদি আরব। আরেকদিকে রয়েছে তুরস্ক। কারণ তাদের দেশেই ঘটেছে ঘটনা। এই খেলায় বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রকে দেখতে চাইছে রেফারির ভূমিকায়।

জামাল খাসোগি আসলে কোথায়, বেঁচে আছেন, না মরে গেছেন—সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তুরস্ক বলছে, সৌদি কনস্যুলেটেই হত্যা করা হয়েছে খাসোগিকে। ভিডিও, অডিওসহ তথ্যপ্রমাণও হাজির করেছে তারা। তবে সৌদি আরব সেসব উড়িয়ে দিয়েছে। সৌদি আরব বলছে, খাসোগি কনস্যুলেটে ঢোকার পরই বের হয়ে গেছেন। তাহলে কোথায় উধাও হলেন তিনি?
বিশ্ব চায়, অনুগত ও মিত্র হিসেবে পরিচিত সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে চাপে ফেলুক যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি আরবের মসনদে সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ থাকলেও দেশটির ক্ষমতার চাবিকাঠি যুবরাজের হাতেই।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চাইলে রেফারির ভূমিকায় সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে নিয়ে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের লুকোচুরি খেলা শেষ করতে পারেন। এখন পর্যন্ত ট্রাম্প সে রকম কোনো জোরালো পদক্ষেপ নেননি।

জামাল খাসোগি কে?
জামাল খাসোগি সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কিছু নীতির ব্যাপারে কট্টর সমালোচক ছিলেন। এ নিয়ে তিনি মতামতও লিখেছেন। ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি হস্তক্ষেপেরও তিনি ঘোর সমালোচক। ৬০ বছর বয়সী সাবেক এই সরকারি উপদেষ্টা সৌদি আরবে গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত জীবন কাটাতেন। ওয়াশিংটন পোস্টে প্রথম লেখায় জামাল খাসোগি অভিযোগ করেন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার বিষয়ে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরোধিতা করায় অসংখ্য মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আল-হায়াত সংবাদপত্রে তাঁর কলাম বাতিলের জন্য সৌদি সরকার চাপ দিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন। ট্রাম্পের প্রতি সৌদি আরবের অতিরিক্ত প্রীতি নিয়ে টুইট না করার জন্যও সতর্ক করে দেওয়া হয়।

জামাল খাসোগি নিখোঁজ হওয়ার সময় তুরস্কের বিমানবন্দরে সৌদি আরবের উড়োজাহাজ দেখা যায়। ছবি: রয়টার্স
জামাল খাসোগি নিখোঁজ হওয়ার সময় তুরস্কের বিমানবন্দরে সৌদি আরবের উড়োজাহাজ দেখা যায়। ছবি: রয়টার্স

কী ঘটেছিল সেদিন?
২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশ করার পর থেকে জামাল খাসোগিকে আর দেখা যায়নি। বিবিসি, সিএনএন, হাফিংটন পোস্ট, আল–জাজিরা ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর বলছে, খাসোগি নিতান্ত ব্যক্তিগত কারণে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে গিয়েছিলেন। সাবেক স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার প্রত্যয়নপত্র নিতে তিনি সেখানে যান। ওই প্রত্যয়নপত্র পেলে তিনি তুর্কি প্রেমিকা হাতিস চেঙ্গিসকে বিয়ে করতে পারতেন। কনস্যুলেটে যাওয়ার আগে খাসোগি তাঁর মোবাইল ফোনটি চেঙ্গিসের হাতে দেন। চেঙ্গিস জানান, কনস্যুলেটে যাওয়ার আগে খাসোগিকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। কোনো শঙ্কা কাজ করছিল তাঁর মনে। বলে গিয়েছিলেন, কনস্যুলেট থেকে বের না হলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের উপদেষ্টাকে ফোন করতে। সেই শঙ্কাই সত্যি হয়েছে।

তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি আরবের কনস্যুলেটের সামনে জামাল খাসোগির পোস্টার হাতে বিক্ষোভ হয়। ছবি: রয়টার্স
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি আরবের কনস্যুলেটের সামনে জামাল খাসোগির পোস্টার হাতে বিক্ষোভ হয়। ছবি: রয়টার্স

চলছে লুকোচুরি খেলা
জামাল খাসোগিকে সৌদি আরব হত্যা করেছে বলে অভিযোগ তুরস্কের। তুর্কি সরকার–সমর্থক দৈনিক সাবাহর খবরে জানানো হয়, জামাল খাসোগিকে হত্যা করতে সৌদি আরব ১৫ সদস্যের স্কোয়াড নিয়োগ দিয়েছিল। রিয়াদ থেকে ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে করে তারা ইস্তাম্বুলে আসে। ওই দলে খাসোগির মরদেহ টুকরো টুকরো করতে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞও ছিলেন। তিনি হাড় কাটার জন্য করাত নিয়ে গিয়েছিলেন। দুই ঘণ্টার মধ্যে খাসোগিকে হত্যার পর ওই দলটি তুরস্ক থেকে বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুরস্ক কর্তৃপক্ষ ওই ১৫ সদস্যকে খুঁজছে। ওই ১৫ জনের নাম ও ছবিও প্রকাশ করেছে সাবাহ। তুরস্কের আরটিআর-টিভিতে প্রচারিত সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ১৫ জন আততায়ী তুরস্ক বিমানবন্দরে প্রবেশের পর হোটেলে উঠছে। খাসোগি কনস্যুলেটে প্রবেশের ঘণ্টাখানেক আগে কিছু গাড়ি দূতাবাসে ঢুকতে দেখা গেছে।

সৌদি আরব অবশ্য এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ব্লুমবার্গকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, জামাল খাসোগি কনস্যুলেট ভবনে গিয়েছিলেন এবং পরে বেরিয়েও যান। তুরস্ক এর প্রমাণ চেয়েছে। এতে দমেনি সৌদি আরব। জানিয়েছে, ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে তুরস্কের তদন্ত দল তল্লাশি করতে পারবে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা জামাল খাসোগিকে নিয়ে রহস্য উদ্‌ঘাটনে সৌদি আরবকে চাপ দেওয়ার পক্ষে। খাসোগি যে কনস্যুলেট থেকে বেরিয়েছিলেন, তারা সৌদি আরবের কাছে এ ব্যাপারে প্রমাণ চায়।

তুরস্কের বিমানবন্দরে সন্দেহভাজন সৌদি এজেন্ট। তুরস্ক এ নিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করেছে। ছবি: রয়টার্স
তুরস্কের বিমানবন্দরে সন্দেহভাজন সৌদি এজেন্ট। তুরস্ক এ নিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করেছে। ছবি: রয়টার্স

রেফারি কি যুক্তরাষ্ট্র?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানোর অভিযোগ রয়েছে। জামাল খাসোগিকে নিয়ে সৌদি আরব ও তুরস্কের পাল্টাপাল্টি দোষারোপের খেলায় তাই যুক্তরাষ্ট্রকে রেফারির ভূমিকায় দেখতে চায় বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা। এর আরও একটি কারণ সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত ও বন্ধু দেশ। তাই খাসোগি কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে যুক্তরাষ্ট্রই শক্ত চাপে ফেলতে পারে সৌদি আরবকে। জামাল খাসোগির বাগদত্তা ও প্রেমিকা হাতিস চেঙ্গিসও খাসোগির খোঁজ চেয়ে ট্রাম্পের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। খাসোগিকে নিয়ে সৌদি আরবকে চাপ দেওয়ার দাবি আছে ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যেও।

সৌদি কনস্যুলেটে যাওয়ার পর বাইরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকেন বাগদত্তা হাতিস চেঙ্গিস। ছবি: এএফপি
সৌদি কনস্যুলেটে যাওয়ার পর বাইরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকেন বাগদত্তা হাতিস চেঙ্গিস। ছবি: এএফপি

এসব আবেদনে সাড়া দিতে যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা নিমরাজি। খাসোগির নিখোঁজের বিষয়ে সৌদি আরবের কাছে জবাব চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি আরবের কাছে ঘটনার আদ্যোপান্ত জানতে চেয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। একই সঙ্গে এই ঘটনাকে ‘খুব ভয়ংকর অবস্থা’ বলেও অভিহিত করেছেন তিনি। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হয় ট্রাম্প যেন অনেকটাই বিব্রত। ততটা কঠোর হতে চান না।

সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির রিপাবলিকান সদস্য সিনেটর বব কর্কার ও ডেমোক্রেটিক সিনেটর বব মেনেনদেজ তাঁদের যৌথপত্রে মাগনিতস্কি মানবাধিকার দায় নামে পরিচিত আইনের ভিত্তিতে খাসোগির নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে তদন্ত চেয়েছেন। এই আইনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বব কর্কার বলেন, এই আইনের ভিত্তিতে সৌদি আরবের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

কোনো কোনো সিনেটর সৌদির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি চুক্তি বাতিলের পক্ষে। ডেমোক্রেটিক সিনেটর টিম কেইন দাবি তুলেছেন, এই নিখোঁজের পেছনে সৌদির কোনো হাত নেই, সে কথা প্রমাণের দায়িত্ব সৌদি সরকারের। আর তা প্রমাণে ব্যর্থ হলে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র বিক্রির যে চুক্তি করেছে তা বাতিল করতে হবে। কেইন সৌদি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি বাতিলেরও পক্ষে। একই কথা বলেছেন রিপাবলিকান সিনেটর র‍্যান্ড পল।

ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

চাপের মধ্যে পড়ে এখন পর্যন্ত ট্রাম্প দুই কূল রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। একদিকে ট্রাম্প বলছেন, খাসোগির নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি তাঁর ভালো লাগছে না। ঘটনার তদন্ত চান। আবার মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে অস্ত্র বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করতে চান না তিনি। গত বৃহস্পতিবার ফক্স টিভিকে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে সৌদি আরবের সঙ্গে স্বাক্ষরিত অস্ত্র বিক্রি চুক্তি বাতিলের বিপক্ষে তিনি। ট্রাম্প মনে করেন তিনি চুক্তি বাতিল করলে অনেক দেশ সেই সুযোগ নেবে।

গত বছর মে মাসে সৌদি আরবে এক সরকারি সফরকালে ট্রাম্প সে দেশের সরকারের সঙ্গে ১১০ বিলিয়ন ডলারের অত্যাধুনিক অস্ত্র বিক্রির চুক্তিতে সই করেন। সৌদি আরবের ইয়েমেন অভিযানের বিপক্ষে অবস্থান ছিল নিখোঁজ সাংবাদিক জামাল খাসোগির। আর সেই ইয়েমেনেই যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি মারণাস্ত্র ব্যবহার করছে সৌদি আরব। যুক্তরাষ্ট্রের বড় তেলের ভান্ডারের জোগান দেয় সৌদি আরব। তেলের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডলার যায় সৌদি আরবে। এত সহজে এসব বাণিজ্যিক স্বার্থ ছাড়বেন না ট্রাম্প।

শেষ পর্যন্ত জামাল খাসোগিকে নিয়ে সৌদির লুকোচুরি খেলায় ট্রাম্প কি রেফারি হবেন? জামাল খাসোগি রহস্যের সমাধান আদৌ হবে কি? এসব প্রশ্নের উত্তর অনেকটাই নির্ভর করছে সৌদি আরবকে যুক্তরাষ্ট্র কতটা চাপ দেয়—তার ওপর। এখন শুধু অপেক্ষা।