দুর্গোৎসবে মাতোয়ারা কলকাতা

দক্ষিণ কলকাতার ৬৬ পল্লির পূজামণ্ডপ। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
দক্ষিণ কলকাতার ৬৬ পল্লির পূজামণ্ডপ। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

লন্ডনের টেমস নদী বইবে কলকাতায়। সত্যি করে বললে, কলকাতার পূজামণ্ডপে। দেখা যাবে টেমস নদীর পাড়ে বিগবেন ঘড়ি। 

লন্ডনের টেমস নদীকে থিম করে এবার মণ্ডপ বানিয়েছে কলকাতার বরাহনগরের লো-ল্যান্ড নেতাজি কলোনির পুজো উৎসব কমিটি। এ মণ্ডপের দুর্গা প্রতিমা সাজানো হয়েছে ৬০ কেজি সোনার গয়না দিয়ে।
কলকাতার অলিগলিতে তৈরি হয়েছে এমন চমক দেওয়া নানা পূজামণ্ডপ। এমন সব অভিনব, সৃজনশীল ধারণা দেখা যাবে কলকাতার পূজামণ্ডপে। বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজাকে ঘিরে সেজে উঠেছে কলকাতাসহ গোটা পশ্চিমবঙ্গ। ছড়িয়ে পড়ছে আলোর রোশনাই দিকে দিকে।

এই উপমহাদেশে কলকাতার দুর্গাপূজার একটা আলাদা নাম আছে, আলাদা ঐতিহ্য আছে। দুর্গাপূজা বলতে এখনো ভারতে প্রথম উঠে আসে কলকাতার নাম।

কলকাতায় এবার পূজায়ও চলছে সাবেকি আর আধুনিক থিম—পুজোর লড়াই। কে কাকে টেক্কা দেবে, তার লড়াই।
উত্তরপাড়ার ভদ্রকালী ইয়ুথ কোর সর্বজনীনে দেখা যাবে এক টুকরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাঁচে এখানে গড়া হয়েছে মণ্ডপ। চীনের শহর দেখা যাবে কলকাতার সল্টলেকের বিজে ব্লকে। সল্টলেকের একে ব্লকেরø এবারের থিম সীতাহরণ। পাহাড়ি শহর দার্জিলিংকে দেখা যাবে কামারডাঙ্গা দুর্গোৎসব সমিতির পূজামণ্ডপে। গোপী-বাঘাসহ ভূতের রাজাকে থিম করেছে বাঘাযতীন তরুণ সংঘ। কলকাতার ভবানীপুর দুর্গোৎসব কমিটি থিম করেছে প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী কিশোর কুমারকে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার লেখা কবিতাকে থিম করেছে ভবানীপুরের স্বাধীন সংঘ।
কলকাতার সন্তোষ মিত্র স্কয়ারের দুর্গোৎসবে এবারের থিম ৪০ কোটির রথে মা দুর্গা আসছেন মর্ত্যে। এই রথে রয়েছে চারটি তলা। ১০ টন রুপা দিয়েছে একটি জুয়েলারি সংস্থা। ‘বাহুবলী’র পর এবার ‘পদ্মাবত’কে থিম করেছে উত্তর কলকাতার শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী মহম্মদ আলি পার্কের এবারের থিমও ‘পদ্মাবত’। দক্ষিণ কলকাতা মুদিয়ালী ক্লাব থিম করেছে ৩৫ ফুট লম্বা আর ৩০ ফুট চওড়া এক জোড়া ডোকরা ঘোড়াকে। বেহালার নস্করপুর সর্বজনীন থিম করেছে বেনারসি হুঁকোর। এক হাজার হাতের দুর্গা বানিয়েছে কামরাবাদ সুভাষপল্লি সর্বজনীন। সল্টলেকের একে ব্লকের পূজার থিম ৪০ ফুটের দশানন বা রাবণ। জুরাসিক পার্ক দেখা যাবে সল্টলেকের এফডি ব্লকে। রাখা হয়েছে বিভিন্ন যুগের ডাইনোসরদের। পাট আর পাটকাঠি দিয়ে মণ্ডপ তৈরি করেছে ত্রিধারা সম্মিলনী।

দমদম পার্ক তরুণ সংঘ মণ্ডপ। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
দমদম পার্ক তরুণ সংঘ মণ্ডপ। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

কলকাতার কোলাঘাট সম্মিলনী থিম করেছে ‘রূপের অন্তরে’। উল্টোডাঙ্গা জাগরণী সংঘের থিম ‘হে মানব’। কেষ্টপুর মাস্টারদা স্মৃতি সংঘের থিম, ‘স্বপ্নের মায়াজাল’। কেষ্টপুর প্রফুল্ল কানন বালকবৃন্দ সর্বজনীনের থিম ‘বাঙাল-ঘটি বিতর্ক’। খালের দুপাড়ে মণ্ডপ তৈরি হয়েছে একদিকে পশ্চিমবঙ্গ আর অন্যদিকে বাংলাদেশকে থিম করে। দমদমের অমর পল্লি সর্বজনীনের থিম ‘আশ্বিনে অসুরবধ, ছৌ করবে বাজিমাত’। বেহালা সর্বজনীনের থিম ‘জাতপাত নিয়ে হানাহানি বন্ধ হোক’। মুদিয়ালি ক্লাবের থিম ‘মায়ের আঁচল’। বড়িশা ইয়ুথ ক্লাবের থিম রান্নাঘরের ‘হাতা-খুন্তি-বঁটি’। উত্তর বড়িশার নবীন সংঘের থিম কলকাতার গঙ্গার প্রিন্সেপ ঘাট। বেহালার দেবদারু ফটকের থিম ‘খাদ্য-সংকট’। নির্ভীক সাংবাদিকতাকে থিম করেছে সিঁথির দুর্গোৎসব কমিটি। সেলিমপুরের ঐকতানের থিম ‘বাজছে ঢাক, বাজছে কাঁসর’। আলিপুর সর্বজনীনের থিম ‘রূপকথা নয়, জীবনের ইতিকথা’। বাংলার প্রাচীন কীর্তন গানকে থিম করেছে দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট সর্বজনীন । আহিরী টোলা সর্বজনীনের থিম কলকাতার আদিগ্রাম সুতানুটি। মুক্তদলের এবারের থিম ‘সৃষ্টির উল্লাসে বাংলা’। বাদামতলা আষাঢ় সংঘ থিম করেছে ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’। কালীঘাট মিলন সংঘের থিম ’ব্রহ্ম’।
আহিরীটোলা যুবকবৃন্দের থিম যৌনকর্মীদের বঞ্চনা। পাইকপাড়া পল্লিবাসীদের থিম রিকশা। শোভাবাজার সর্বজনীনের থিম ‘অতিরিক্ত খাবার ফেলবেন না; গরিবকে দান করুন’। দমদম পার্ক সর্বজনীনের থিম ‘পরিবেশ বাঁচান’। লেকটাউন নেতাজি স্পোর্টিং ক্লাবের থিম ‘বাংলার নাটক কথা’। উত্তর কলকাতার চালতাবাগান সর্বজনীন থিম করেছে কবিগুরুর ‘শান্তিনীড়’। কলেজ স্কোয়ের থিম অকাল বোধনের গল্প। শিয়ালদহ অ্যাথলেটিক ক্লাবের থিম এক আদিবাসী গ্রামের কথা। দেশপ্রিয় পার্কের এবারের থিম ‘রাজনন্দিনীর রাজমহল’। সিংহী পার্কের থিম পুরীর সূর্য মন্দির। একডালিয়া এভারগ্রিন মন্দির বানিয়েছে তাঞ্জোরের বৃহদেশ্বর মন্দিরের আদলে। বোস পুকুর শীতলা মন্দিরের থিম ‘উলকি সাজে ঘোড়ায় চড়ে মা আসছেন, গোন্দদের ঘরে’। রাজডাঙ্গা নব উদয় সংঘের এবারের থিম ’মহাকর্ষ মহামায়া’।
কলকাতার পূজা দেখতে এবারও হাজির দেশ-বিদেশের ভক্ত আর পর্যটকেরা। আসছে বাংলাদেশ থেকে হাজারো ভক্ত ও পর্যটক। সীমান্তে এখন বিদেশি পর্যটকদের ভিড়ে হিমশিম খাচ্ছেন শুল্ক ও অভিবাসন দপ্তরের কর্মকর্তারা। বেনাপোল-হরিদাসপুর, গেদে-দর্শনা, আগরতলা, ভোমরা, সব সীমান্তেই এখন মানুষের ঢল নেমেছে। ছুটে আসছেন বাংলাদেশের প্রচুর মানুষজন কলকাতায় । সেই সঙ্গে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও মানুষ ছুটছেন বাংলাদেশে। কারণ, কলকাতার পর এখন নাম বাংলাদেশের। তাইতো শিকড়ের খোঁজে দুর্গোৎসবকে সঙ্গী করে অনেকেই পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশেও। এই চিত্র আজ পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ সীমান্তের সর্বত্র।

পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরা হলো বাঙালিদের আবাসভূমি। এ ছাড়া দিল্লি , মুম্বাই, আসাম, মেঘালয়, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশ, ওডিশা, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ সর্বত্রই অনুষ্ঠিত হয় এই দুর্গোৎসব। মোট কথা, যেখানে বাঙালির বাস সেখানে দুর্গাপূজা।