খাসোগির অন্তর্ধানের পর আলোচনায় কুশনার

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা ও হোয়াইট হাউসের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার। ফাইল ছবি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা ও হোয়াইট হাউসের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার। ফাইল ছবি

সৌদি রাজতন্ত্রের কঠোর সমালোচক হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক জামাল খাসোগি নিখোঁজ হয়েছেন প্রায় দুই সপ্তাহ আগে। ২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে তিনি এসেছিলেন নিজের বিয়ের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে। তুরস্ক অভিযোগ করেছে, সম্ভবত এই কনস্যুলেটেই খাসোগিকে হত্যা করে গোপনে তাঁর লাশ সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

যাঁরা সৌদি রাজনীতির নাড়িনক্ষত্র জানেন, তাঁদের ধারণা, এই কথিত অপহরণ ও হত্যার পেছনে রয়েছেন তরুণ সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, যাঁর অন্য নাম এম বি এস। জামাল খাসোগি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে সমালোচনা করেছিলেন, প্রিন্স সালমানের তা ভালো লাগেনি। গত বছর বাদশাহ সালমান তাঁর এই প্রিয় পুত্রটিকে নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করার পর থেকেই তিনি বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন। সীমিত আকারে হলেও নারীদের অধিক স্বাধীনতা সমর্থন করার পর এম বি এস পশ্চিমা নেতাদের চোখে সংস্কারক হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এই পশ্চিমা নেতাদের অন্যতম হলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জামাতা ও হোয়াইট হাউসের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার।

ক্ষমতায় আরোহরণের পরপরই ৩৩-বছর বয়স্ক সালমান ও ৩৭-বছর বয়স্ক কুশনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হন। ব্যবসায়িক সূত্রে ট্রাম্প ও কুশনার পরিবার অনেক আগে থেকেই সৌদি আরবের সঙ্গে নিকট সম্পর্কে জড়িত। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্প তাঁর অকূটনীতিক জামাতা কুশনারকে মধ্যপ্রাচ্য নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব দেন। এই দায়িত্ব পালনে কুশনার তাঁর মই হিসেবে সালমানকে নির্বাচন করেন। এই দুজন দ্রুত এত ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন যে, প্রচলিত সব নীতি ভঙ্গ করে তাঁরা অনেক সময় একান্তে একে অপরের সঙ্গে কথা বলেন। কী কথা বলেছেন, অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁরা নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছেন, তার কোনো নথিপত্র নেই।

কুশনারের পরামর্শেই গত বছর ট্রাম্প বিদেশে তাঁর প্রথম সরকারি সফরের জন্য সৌদি আরবকে নির্বাচন করেন। সেই সফরের ফলেই ট্রাম্প সৌদি আরবের সঙ্গে ১০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র বিক্রির চুক্তি করতে সক্ষম হন।

কুশনার আশা করেছিলেন, সালমানের সমর্থনে তিনি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি বাস্তবসম্মত শান্তি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে সক্ষম হবেন। অন্যদিকে সালমান আশা করেছিলেন কুশনারের সমর্থনে তিনি ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শত্রু হিসেবে প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবেন। সালমান সে চেষ্টায় সক্ষম হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ইরানের সঙ্গে বহুজাতিক পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে। ইরানকে একঘরে করার লক্ষ্যে সৌদি সমর্থনে ট্রাম্প প্রশাসন ইতিমধ্যে ইরানের বিরুদ্ধে নতুন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রশ্নে এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি হয়নি।

তিন মাস আগে কুশনার তাঁর শান্তিচুক্তির একটি নীলনকশা নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তিনি আশা করেছিলেন, তাঁর বন্ধু সালমানের কারণে সৌদি বাদশাহ চুক্তিটির প্রতি সমর্থন জানাবেন। যতদূর জানা যায়, কুশনার তাঁর নীলনকশায় ফিলিস্তিনকে পূর্ণ স্বাধীনতার বদলে জর্ডানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব করেন। সৌদি বাদশাহ সে প্রস্তাব এক কথায় নাকচ করে দেন। কুশনারের জন্য সেটি ছিল বড় ধরনের ধাক্কা।

সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেলটা মন্তব্য করেছেন, কুশনার সালমানের কাছ থেকে বড় বেশি আশা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য একটি জটিল ও বহুস্তরবিশিষ্ট সংকট, এর মোকাবিলায় যে কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা প্রয়োজন, কুশনারের তা নেই।
জামাল খাসোগির অন্তর্ধানের ব্যাপারটি ট্রাম্প ও কুশনার উভয়ের জন্য বড় ধরনের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠেছে। হোয়াইট হাউস থেকে বলা হয়েছে, গত সপ্তাহে কুশনার নিজে সালমানের সঙ্গে খাসোগির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সালমান এ ব্যাপারে তাঁর অথবা সৌদি রাজপরিবারের কোনো সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু তাতে সন্দেহ মেটেনি। মার্কিন সিনেটে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক উভয় দলের সদস্যরাই এই ব্যাপারে সৌদি আরবের কাছ থেকে সদুত্তর দাবি করেছেন।

যদি খাসোগির মৃত্যুর ব্যাপারে সৌদি হস্তক্ষেপ প্রমাণিত হয়, তাহলে এই দেশ ও তার নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি তাঁরা তুলেছেন।

প্রথম প্রথম ট্রাম্প নিজে এই সমস্যা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন। তিনি এমন কথাও বলেন, সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কোনো রকম নিষেধাজ্ঞা আরোপের তিনি বিরোধী, কারণ সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনতে রাজি হয়েছে।

কিন্তু এই ঘটনার পেছনে সৌদি হাত রয়েছে, এই সন্দেহ ঘনীভূত হওয়া শুরু হলে ট্রাম্পকেও সুর বদলাতে হয়। রোববার সিবিএস টিভির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, সৌদি সম্পৃক্তির কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে সে জন্য তাদের কঠোর মূল্য দিতে হবে। তিনি অবশ্য খোলাসা করে বলেননি ঠিক কী শাস্তির কথা তিনি বিবেচনা করছেন।

মার্কিন বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, জামাল খাসোগির অন্তর্ধানের পেছনে প্রিন্স সালমানের ভূমিকা প্রমাণিত হলে যতটা না ট্রাম্প নিজে, তার চেয়ে কুশনার অধিক সমালোচনার সম্মুখীন হবেন। সৌদি আরবের অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে গেছে। ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বে যে সামরিক অভিযান চলছে, আন্তর্জাতিক নিন্দা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র তাতেও সমর্থন দিয়ে গেছে। উভয় ক্ষেত্রেই কুশনারের ব্যক্তিগত প্রভাব ভূমিকা রেখেছে। একজন মার্কিন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, এম বি এস নির্বোধ কুশনারকে নিয়ে ইচ্ছামতো খেলা করেছে।