কেরালায় বিক্ষোভের মুখে মন্দিরে ঢুকতে পারেননি দুই নারী

আয়াপ্পা দেবতার মন্দিরে প্রবেশের সোনার তৈরি সিঁড়ি ধুয়ে–মুছে পরিষ্কার করছেন এক ভক্ত। ছবি: এএফপি
আয়াপ্পা দেবতার মন্দিরে প্রবেশের সোনার তৈরি সিঁড়ি ধুয়ে–মুছে পরিষ্কার করছেন এক ভক্ত। ছবি: এএফপি

পাহাড়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ বেয়ে উঠেছিলেন তাঁরা। সোনার তৈরি ধাপটিতে পৌঁছাতে সিঁড়ির আর মাত্র ১৮টি ধাপ বাকি ছিল। দূরত্ব মাত্র ৫০০ মিটার। এই সোনালি ধাপটুকু পেরোতে পারলেই তাঁরা পৌঁছে যেতেন পবিত্র মন্দিরটিতে। গড়তে পারতেন ধর্মীয় গোঁড়ামি ভঙ্গের ইতিহাস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় উন্মাদনার কাছে হার মানতেই হলো তাঁদের। আইনও তাঁদের এই পবর্তসম ধর্মান্ধতাকে চিরে আলো পৌঁছানোর পথ তৈরি করে দিতে পারল না।

ভারতের কেরালা রাজ্যে সাবারিমালায় পাহাড়ের ওপর আয়াপ্পা দেবতার মন্দিরে দুই নারীকে প্রবেশ থেকে বিরত রাখতে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন পুরোহিতেরা। নারীদের মাসিকের সময় বিবেচনায় ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সী নারীদের মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। শত শত বছর ধরে চলে আসছে এই রীতি।

পুরোহিতদের এই বাধার মধ্য দিয়ে যেন আরেকবার প্রমাণ হলো, পুরুষেরাই ধর্মীয় ব্যাপারে নেতৃত্বের অবস্থানে থাকবেন। নারীরা শুধুই পালন করে যাবেন। তা–ও পালন করতে হবে পুরুষের বেঁধে দেওয়া নিয়মের বেষ্টনীর মধ্যে থেকে। ধর্ম নিয়ে নারীরও যে আবেগ প্রকাশের অধিকার আছে, তা যেন উপেক্ষিতই থেকে যাবে। ধর্মপ্রাণ নারীদের যেন তা–ই করতে হবে, যা পুরুষ চায়।
যে দুই নারী রীতি ভাঙার সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, মন্দিরে পৌঁছানোর আইনি প্রবেশাধিকার তাঁরা সঙ্গে নিয়েই গিয়েছিলেন। কিন্তু আইন তাঁদের রক্ষাকবচ হতে পারেনি।

এনডিটিভি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, শুক্রবার পুলিশি পাহারায় একজন সাংবাদিকসহ দুজন নারী লক্ষ্যে পৌঁছানোর সময় শেষ ধাপে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মন্দিরের পুরোহিতরা। নারী দুজন শেষ আধা কিলোমিটারের সোনালি ধাপ পেরোতে চাইলে প্রতিহত করার হুমকি দিয়েছিলেন তাঁরা। সব ধরনের ধর্মীয় প্রথা ও প্রার্থনা বন্ধ করে মন্দির বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।
সাবারিমালা মন্দিরের প্রধান পুরোহিত কানদারারু রাজিভারু বলেন, ‘আমরা মন্দির বন্ধ করে চাবি হস্তান্তর করে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি ভক্তদের পাশে আছি। আমার কাছে আর কোনো উপায় নেই।’

আয়াপ্পা দেবতার মন্দিরে নারীদের প্রবেশে বাধা দিতে পথ অবরোধ করে রেখেছেন ভক্তরা। ছবি: এএফপি
আয়াপ্পা দেবতার মন্দিরে নারীদের প্রবেশে বাধা দিতে পথ অবরোধ করে রেখেছেন ভক্তরা। ছবি: এএফপি

পুলিশ দুই নারীকে এই বার্তা জানানোর পর তাঁরা ফিরে আসতে রাজি হন। ঘটনাস্থলে পুলিশের দলের নেতৃত্বে থাকা মহাপরিদর্শক (আইজি) এস শ্রিজাত বলেন, ‘আমরা নারীভক্তদের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেছি, তাঁরা ফিরে যেতে রাজি হয়েছেন। তাই আমরা ফিরে যাচ্ছি। তাঁরা আবার ফিরে আসার কথা জানিয়েছেন।’

সকালে বিক্ষোভরত ভক্তদের উদ্দেশে শ্রিজাত বলেন, ‘আমিও একজন আয়াপ্পাভক্ত। এখানে এসেছি সুপ্রিম কোর্টের আদেশ পালনে। আমি মনে করি, নারীদের মন্দিরের ভেতর প্রবেশের অধিকার রয়েছে।’
কিন্তু বিক্ষোভকারীরা তাঁর আহ্বানে সাড়া দেননি। তাঁরা দুই নারীর মন্দিরে প্রবেশের মুখে বাধা দেন।

গত মাসে দেবতা আয়াপ্পার মন্দিরে নারীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আদেশ দেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। এই ঐতিহাসিক নির্দেশের পর তিন দিন আগে মন্দিরটির খোলা হয়। অন্য ভক্তদের মতে, আদালত সে ক্ষেত্রে আবেগ ও ঐতিহ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নেননি। তাঁদের ভাষায়, আয়াপ্পা একজন কুমার দেবতা এবং নারীদের ঋতুকালীন বয়স ‘বিশুদ্ধ নয়’।

মন্দিরটি পরিচালনায় থাকা দেবাসম বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী কাদাকামপালি সুরেনদ্রান এনডিটিভিকে বলেছেন, যে দুজন নারী মন্দিরে প্রবেশের চেষ্টা করেছেন, তাঁরা ভক্ত নন, অধিকারকর্মী। সত্যিকারের কোনো ভক্ত সেখানে যেতে চাইলে সুরক্ষা দেওয়া হবে। কিন্তু কোনো অধিকারকর্মীকে সাবারিমালাকে তাঁদের জায়গা হিসেবে প্রমাণের সুযোগ দেওয়া হবে না।

হায়দরাবাদের মোজো টিভির সাংবাদিক কবিতা জাক্কাল হলুদ হেলমেট মাথায় বিক্ষোভের মধ্যে মন্দিরে যাচ্ছিলেন। তাঁকে ঘেরাও করে রেখেছিল পুলিশ। ৩০০ পুলিশ ঘেরাও করে নিয়ে যাচ্ছিল তাঁকে। আরেক নারী কালো শাড়ি পরে, দেবতা আয়াপ্পার জন্য রীতি অনুসারে প্রার্থনার সরঞ্জাম মাথায় নিয়ে আলাদাভাবে হেঁটে যাচ্ছিলেন। ৪৬ বছর বয়সী নারী ম্যারি সুইটি ফিরে আসতে রাজি ছিলেন না। তিনি জানান, তিনি গির্জা, মসজিদ, মন্দিরে গেছেন, আয়াপ্পাও দেখতে চান। সে সময় পুলিশ তাঁকে নিজ দায়িত্বে যেতে বলেন। পাম্বা থেকে তাঁরা ৪ দশমিক ৬ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠেছিলেন।
বিক্ষোভকারী ভক্তদের দুই দিন ধরে মন্দিরে নারীদের প্রবেশে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে নিলাক্কাল ও পাম্বা বেজ ক্যাম্পে সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে । সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে, তাঁদের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। ক্রমাগত হুমকির মুখে নারীরা ফিরে আসতে বাধ্য হন।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালেও দুজন সাংবাদিক যাঁর একজন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’–এর ভারতীয় সাংবাদিক মন্দিরের ভেতর প্রবেশের চেষ্টা করে বিক্ষোভকারীদের বাধার মুখে ফিরে আসেন।