সিবিআইয়ে ক্ষমতার লড়াই

অলোক ভার্মা
অলোক ভার্মা

ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও ভারতের অন্যতম প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা সিবিআই–এর ক্ষমতার লড়াই প্রকাশ্যে এসে গেল। লড়াই এতটাই তীব্র যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আজ সোমবার ডেকে পাঠালেন যুযুধান দুই পদাধিকারীকে। কিন্তু সেই বৈঠকের পরেই দুর্নীতির অভিযোগে সিবিআই গ্রেপ্তার করে সংস্থারই শীর্ষ পুলিশ অফিসার দেবেন্দ্র কুমারকে।

সিবিআইয়ের লড়াইয়ের দুই চরিত্রের একজন সংস্থার পরিচালক অলোক ভার্মা, অন্যজন বিশেষ পরিচালক রাকেশ আস্থানা। অলোক ভার্মার নির্দেশেই আস্থানাসহ মোট পাঁচজনের বিরুদ্ধে গত রোববার দুর্নীতির অভিযোগে পুলিশে অভিযোগ দাখিল করে সিবিআই। বাকি চারজনের একজন দেবেন্দ্র কুমার। অন্য তিনজনের সঙ্গে সিবিআই সম্পর্কহীন। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা মাংস রপ্তানিকারক মইন কুরেশির হয়ে আস্থানাকে ৫ কোটি রুপি ঘুষ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত। মইন কুরেশির বিরুদ্ধে বিদেশে রুপি পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে।

রাকেশ আস্থানা গুজরাট ক্যাডারের আইপিএস। নরেন্দ্র মোদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ। ২০০২ সালে গোধরা হত্যাকান্ড নিয়ে যে বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করা হয়েছিল, আস্থানা ছিলেন তার নেতা। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদি তাঁকে সিবিআইয়ের বিশেষ পরিচালক পদে নিয়ে আসেন ভবিষ্যতে সংস্থার প্রধান করবেন এই আশায়। সে জন্য বিশেষ পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় রুপক কুমার দত্তকে। আস্থানার ওই নিয়োগকে কেন্দ্র করে তখনই শুরু হয়েছিল বিতর্ক। কিন্তু সেই বিতর্ককে ছাপিয়ে গেছে এখনকার ক্ষমতার লড়াই।

রাকেশ আস্থানা
রাকেশ আস্থানা

সিবিআইয়ের বর্তমান পরিচালক অলোক কুমার উত্তর প্রদেশ ক্যাডারের আইপিএস। আগামী জানুয়ারি মাসে তাঁর অবসর নেওয়ার কথা। কিন্তু আস্থানার পদোন্নতিকে ঘিরে প্রশ্ন উঠে গেল দুর্নীতির ভুরি ভুরি অভিযোগের দরুণ। মাংস রপ্তানিকারক মইন কুরেশির বিরুদ্ধে বিদেশে রুপি পাচারের যে তদন্ত সিবিআই চালাচ্ছে, অভিযোগ রয়েছে, তা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য আস্থানার তরফে ঘুষ চাওয়া হয়। হায়দরাবাদের এক ব্যবসায়ী সানা সতীশ বাবুর কাছ থেকে আস্থানার নাম করে মোট ৫ কোটি রুপি চাওয়া হয় যাতে মইন কুরেশি মামলা ধামাচাপা দেওয়া যায়। অভিযোগ, দুবাইয়ের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের মনোজ প্রসাদ ও সোমেশ প্রসাদসহ আরও একজন এই যোগসাজশের সঙ্গে যুক্ত। আরও অভিযোগ, ইতিমধ্যেই ২ কোটি রুপি হাতবদল হয়েছে। এ ছাড়া গুজরাটের সংস্থা ‘স্টারলিং বায়েটেক’ থেকে ৩ কোটি ৮০ লাখ রুপি ঘুষ নেওয়ার এক অভিযোগও আস্থানার বিরুদ্ধে রয়েছে।

আস্থানার বিরুদ্ধে এইসব দুর্নীতির অভিযোগ পুলিশের কাছে দাখিল করার পর আস্থানার পক্ষ থেকেও অলোকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। ক্যাবিনেট সচিব প্রদীপ কুমারের কাছে চিঠি লিখে তিনি অলোক ভার্মার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, ভার্মা তাঁর তদন্তের কাজে হস্তক্ষেপ করছেন। অভিযোগ জানানো হয় সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশনের কাছেও। পাল্টাপাল্টি এই অভিযোগ, প্রকাশ্যে এমন লড়াই সিবিআইয়ের ইতিহাসে আগে দেখা যায়নি।

এই রেষারেষি প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাতে রাজনৈতিক রং লেগে যায়। আস্থানাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এবং তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর ‘ব্লু আইড বয়’ আখ্যা দিয়ে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী ট্যুইটে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নয়নের মণি, যিনি গুজরাট ক্যাডারের অফিসার, গোধরাকান্ডের তদন্তের মাথা এবং সিবিআইয়ের দু নম্বর, তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ এসেছে। এই প্রধানমন্ত্রীর আমলে সিবিআই এখন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ বিকেলে কংগ্রেসের পক্ষে সাংবাদিক বৈঠকে সচিন পাইলট বলেন, এই সরকার একটা সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে নিয়ে ফেলেছে। নিছক রাজনীতিই এর জন্য দায়ী।

অলোক ভার্মা ও রাকেশ আস্থানার এই ক্ষমতার লড়াইয়ের মোকাবিলা প্রধানমন্ত্রী কীভাবে করবেন তার কোনো ইঙ্গিত এখনো নেই। দুই যুযুধান অফিসারের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছেন এই পর্যন্ত। কিন্তু তারপর কী হবে সেই ইঙ্গিত এখনো পাওয়া যায়নি। তবে এটা ঠিক, আস্থানার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এবং তাঁর অধীনে গঠিত বিশেষ তদন্তকারী অফিসার দেবেন্দ্র কুমারকে গ্রেপ্তার করার পর ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিতে বাধ্য। ভার্মার পর আস্থানাকেই সিবিআইয়ের পরিচালক করতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এফআইআর দাখিল হওয়ার পর তা কতটা সম্ভবপর হবে সেই প্রশ্ন উঠে গেছে।

কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে সিবিআইয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং এই ‘সংস্থার স্বশাসিত’ চরিত্র নিয়ে। সিবিআই শাসক দলের অঙ্গুলি হেলনে চলে বলে যে অভিযোগ বিরোধীরা করে আসছে, এই ঘটনার পর সেই প্রচারই মান্যতা পাবে।