জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেওয়া হলো না মরিসনের!

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল বিদেশে সিডনিতে ফিরলেন। ছবি: সংগৃহীত
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল বিদেশে সিডনিতে ফিরলেন। ছবি: সংগৃহীত

গত শনিবার অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল উপনির্বাচনে সিডনির নিকটবর্তী নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের ওয়েন্টওর্থ নির্বাচনী এলাকায় সরকারী দল লিবারেল পার্টির ভরাডুবি হয়েছে। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে সংখ্যালঘু সরকারে পরিণত হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান সরকার। এ সরকার এখন আর নতুন কোনো বিল আইনে পরিণত করতে পারবে না। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন নির্বাচনের আগে যে বহুল সমালোচিত টোপটা ফেলেছিলেন সেটা এখন ভোটের রাজনীতির কথার কথা ছাড়া আর কোনো মূল্যই রইল না।

১১৭ বছরের ইতিহাসে ওয়েন্টওর্থ নির্বাচনী আসনে এই প্রথম লিবারেল পার্টির এত বড় ভরাডুবির কারণ কি, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের খুব বেশি চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়েনি। কারণ এদিক সেদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিছু অজুহাত খুঁজে পেলেও মূলত কিছুদিন আগে সাবেক হওয়া প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুলই বিদেশে বসে নিজের দলের বিরুদ্ধে কলকাঠি নেড়ে এ ভরাডুবির অংশ হয়েছেন বলে স্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে।

সংসদের মোট ১৫০ আসনের মধ্যে অর্ধেকের চেয়ে একটি বেশি অর্থাৎ ৭৬টি আসনে জয় লাভের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করেছিল লিবারেল পার্টি। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান সংসদের স্পিকার টনি স্মিথ লিবারেল পার্টি থেকে নির্বাচিত হয়। ফলে স্পিকার হিসেবে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা নেই তাঁর। এরপর গত শনিবারের ওয়েন্টওর্থ উপনির্বাচনে হেরে যাওয়ার মাধ্যমে লিবারেল তাদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা হারিয়েছে। সংসদের অর্ধেকের বেশি আসনের কম এখন লিবারেলের আসন সংখ্যা। ফলে, এ সরকার সংখ্যালঘু সরকারে পরিণত হয়েছে। সংখ্যালঘু সরকার যেকোনো মুহূর্তে পতনের শঙ্কা থাকে। কেননা, বিরোধী দল যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় তবে যেকোনো মুহূর্তে সরকার গঠনের জন্য আবেদন করতে পারে। তবে যেহেতু বর্তমান বিরোধী দল লেবার পার্টির আসন সংখ্যা ৬৯টি এবং জাতীয় নির্বাচন আসন্ন, তাই আপাতত সেই শঙ্কা হয়তো নেই লিবারেলের। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকার ফলে জাতীয় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিল সংসদে পাশ করাতে পারবে না। অন্যদের সহযোগিতা নিয়ে যদিও করতে পারে তবে বেশ ঝক্কি পোহাতে হবে নিঃসন্দেহে। সরকারের এ রকম একটা বিপদসংকুল সময়ে স্থানীয় সময় সকালেই দীর্ঘ বিদেশ বাসের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল সিডনি ফিরেছেন। সেটা শনিবার ওয়েন্টওর্থ উপনির্বাচনে লিবারেল পার্টির ঐতিহাসিক পরাজয়ের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসলেন। ওয়েন্টওর্থ আসন থেকে জিতেই টার্নবুল প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাঁর শূন্য আসন পূরণেই এই উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গত আগস্টে দেশটির ক্ষমতাসীন দল লিবারেল পার্টির নেতৃত্ব পরিবর্তনের জের ধরে ক্ষমতাচ্যুত হন টার্নবুল। এর পরপরই স্ত্রী লুসিসহ তিনি নিউইয়র্কে চলে যান। এরপর ফিরে আসেন সিঙ্গাপুরে সেখানে দীর্ঘদিন টার্নবুলের আইনজীবী ছেলে অ্যালেক্স টার্নবুলের কাছে অবস্থান শেষে আজ ফিরে আসেন অস্ট্রেলিয়ায়। শনিবারের উপনির্বাচনের আগ থেকেই অ্যালেক্স সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে লিবারেল পার্টির সমালোচনা করে আসছিলেন।

এবারের এই উপনির্বাচন যে গুরুত্ব বহন করেছে সাধারণত এরকমটি হয় না অস্ট্রেলিয়ায়। এবার গোটা অস্ট্রেলিয়ার চোখ চলল এই উপনির্বাচনের ওপর। ওয়েন্টওর্থ-এ উপনির্বাচনের গুরুত্বের কয়েকটি কারণ হলো, স্কট মরিসন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর তাঁর নির্বাচনী পরিচালন পরীক্ষা, সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখার পরীক্ষা সর্বোপরি আসন্ন ফেডারেল নির্বাচনে দলের জনপ্রিয়তার পরীক্ষা। কিন্তু টার্নবুল একাই এই সকল পরীক্ষার পরীক্ষক হয়ে সব বিষয়ে ফেল করিয়ে নিজ দলকে ছুড়ে দিয়েছেন মহাসমুদ্রে এমনটাই এখন বলাবলি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতির মহলে। টার্নবুল ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাঁর আসনটি ছেড়ে দেন তিনি। এমনকি রাজনীতি থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নেন। ফলে তাঁর ছেড়ে দেওয়া সে আসনে প্রার্থিতা দেয় লিবারেল পার্টি। এই আসনটি টার্নবুলের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ছিল। টার্নবুলের আদি নিবাসও এই নির্বাচনী এলাকাতেই। এ ছাড়া, গত ১১৭ বছরে এই আসন থেকে লিবারেল পার্টি কখনও নির্বাচনে হারে নি। অথচ সেই আসনেই ইতিহাস ভেঙে দিয়ে আপাতত ১ হাজার ৬০০ ভোটে হেরেছে লিবারেল প্রার্থী ডেভ শর্মা। ডেভ শর্মা একজন প্রভাবশালী প্রার্থী ছিলেন। তাঁকে হারিয়ে আসনটি থেকে জয় লাভ পায় স্বতন্ত্র প্রার্থী ও একজন স্থানীয় চিকিৎসক কেরিন ফেলপস। এই উপনির্বাচনে টার্নবুল দলকে কোনোভাবেই সাহায্য করেন নি বলে অভিযোগ করেছেন দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন। এক বিবৃতিতে মরিসন উল্লেখ করেন, লিবারেল প্রার্থী ডেভ শর্মাকে সহযোগিতা করতে টার্নবুলকে লিখিত অনুরোধ করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে দেন।

এ দিকে, টার্নবুল উপনির্বাচন থেকে যতটাই দূরত্ব বজায় রেখেছেন, তাঁর ছেলে অ্যালেক্স ততটাই কাছে থেকেছেন। উপনির্বাচনকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একের পর এক লিবারেল পার্টির সমালোচনা করেই গেছেন অ্যালেক্স। প্রথম থেকেই ডেভ শর্মাকে সমর্থন করা তো দূরের কথা, উল্টো লিবারেল সমর্থকদের সঙ্গে লিবারেল পার্টি ত্যাগের জন্য বিতর্ক করেছেন। এমনকি বর্তমান মরিসন সরকারকে চরমপন্থী বলেও উল্লেখ করেন তিনি। অনেকটা নিশ্চিত গুঞ্জন এই উপনির্বাচনের আগে অ্যালেক্স বিরোধী দল লেবার পার্টিকে অর্থায়নও করেছেন। শনিবারের নির্বাচনী ফলাফলে স্বতন্ত্র প্রার্থী ফেলপস জিতে যাওয়ার পরপরই অ্যালেক্স এক টুইটে বলেন, ‘আমার কাজ এখানেই শেষ। এশিয়ার পুঁজি বাজারে ফেরত যাওয়ার সময় এসেছে।’

টার্নবুল দলের গুরুত্বপূর্ণ এবং বিপদের সময়ে লিবারেলের পাশে না থাকায় ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন রাজনৈতিক অঙ্গনে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও লিবারেল পার্টির অন্যতম নেতা টনি অ্যাবোট লিবারেল পার্টির এই কঠিন অগ্নিপরীক্ষার সময় পাশে না থাকার দরুন কঠোর সমালোচনা করেছেন। গত সপ্তাহে রেডিওতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অ্যাবোট বলেন, ‘আমি জানি তিনি সস্ত্রীক নিউইয়র্কে অবকাশ যাপনে আছেন এটা আমি বুঝতে পেরেছি। আমি এও জানি অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে তিনি আর খুব বেশি জড়িত হতে চান না। কিন্তু অন্তত এই সপ্তাহে দলের হয়ে ডেভ শর্মার পাশে দৃঢ়, স্বচ্ছ ও ব্যক্তিগতভাবে অবস্থান করে ওয়েন্টওর্থের জনগণের কাছে লিবারেলের আকুতি তুলে ধরার প্রয়োজন ছিল। অ্যাবোটের সঙ্গে সুর মিলিয়ে দেশটির সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী বার্নাবি জয়সি বলেন, ডেভ শর্মাকে ভোট দিন। তাঁকে শুধু এই টুকুই বলতে হতো। টার্নবুল একটি বিশাল প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মালিক। আশা করেছিলাম মাত্র এ কয়েকটা শব্দ তিনি বলতেই পারেন।