অশান্তির করিডরে শান্তির আবাস

ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের বাসিন্দাদের অভিযোগ—প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে এই এলাকা তাঁদের জন্য বন্ধ। ছবি: রয়টার্স
ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের বাসিন্দাদের অভিযোগ—প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে এই এলাকা তাঁদের জন্য বন্ধ। ছবি: রয়টার্স

১৯৯৪ সালে ইসরায়েল ও জর্ডানের মধ্যে শান্তিচুক্তি হওয়ার পর সীমান্ত বরাবর ছোট্ট একটি করিডরকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ইসরায়েল। কারণ, ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ২ কিলোমিটার প্রশস্ত ওই করিডর ছিল ভয়াবহ বিপজ্জনক। অসংখ্য মাইন পোঁতা রয়েছে এখানে, যা কখনো অপসারণ করা সম্ভব নয়। সামরিক বাহিনী পুরো করিডর কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে ‘প্রবেশ নিষেধ’ লিখে রেখেছে। এসব না করলেও ওই এলাকায় ঢোকার সাহস কেউ করতেন না।

অসম্ভব সুন্দর ওই করিডর ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে বন্য প্রাণী আর পাখিদের প্রাকৃতিক অভয়াশ্রম। অনধিকার প্রবেশ না হওয়ায় পোয়াবারো হয়েছে পশুপাখির জন্য। কোনো হুমকি না থাকায় বিপন্ন প্রজাতিগুলোর আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে ওই ভূমি। ইউরোপ ও আফ্রিকা পরিযায়ী পাখিদের জন্য জর্ডান উপত্যকার এই করিডর একটি গুরুত্বপূর্ণ আবাস। হরিণ, শিয়াল, হায়েনা ও বনবিড়ালের জন্য এ অঞ্চল ভূস্বর্গ। রয়েছে অসংখ্য প্রজাতির বাদুড়। এই নিশাচর প্রাণীদের গ্রীষ্মকালীন আবাস হলো এ অঞ্চল।

ইসরায়েলের প্রাকৃতিক সুরক্ষা সোসাইটির পরিবেশবিদ স্মুলিক ইয়েদভাব অনেক বছর ধরে এখানকার বাদুড়ের কলোনিগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন। উন্নত যন্ত্রপাতি ও আলট্রাসনিক ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে ভিন্ন ধরনের প্রাণীর স্বর রেকর্ড করেছেন তাঁরা, যাদের অস্তিত্ব আগে কোথাও পাওয়া যায়নি।

ইয়েদভাব বলেন, ‘হাজার হাজার বাদুড়ের কলোনি আছে। এখনো নতুন প্রজাতি পাওয়া যায়। সংরক্ষণের দৃষ্টিকোণ থেকে বদ্ধ সামরিক অঞ্চল সেরা। সত্যি বলতে কি, আমরা আশা করব, জোনটিতে কখনো মাইন অপসারণ করা হবে না। ’

কিন্তু কত দিন থাকবে বাদুড়ের এই অভয়াশ্রম? ইসরায়েলের ভূমির ২২ শতাংশ প্রকৃতির জন্য সংরক্ষণ রাখা হয়েছে । তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চ হারের কারণে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন—দুই দেশেরই জমির জন্য প্রতিযোগিতা তীব্র হচ্ছে। ইসরায়েলের জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হার ২ শতাংশ ও ফিলিস্তিনের ৩ শতাংশ। গত কয়েক বছরে ইসরায়েলে মেদজুল খেজুর চাষের ব্যাপক প্রসার হয়েছে। কৃষকেরা চাইছেন পূর্বাংশে তাঁদের চাষ সম্প্রসারণ করতে। এমনকি নিজ অর্থে মাইন অপসারণ করতে হলেও এখানে চাষ করতে বদ্ধপরিকর তাঁরা।

১৯৬৭ সালে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয় ইসরায়েল। ছবি: রয়টার্স
১৯৬৭ সালে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয় ইসরায়েল। ছবি: রয়টার্স

যেখানটায় বিরোধ
১৯৬৭ সালে আরবদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয় ইসরায়েল। ছয় দিনের ওই যুদ্ধে মিসর, সিরিয়া ও জর্ডানের সেনারা ইসরায়েলের কাছে পরাজিত হয়। গাজা উপত্যকা, মিসরের সিনাই উপত্যকা, সিরিয়ার গোলান মালভূমি ও জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে ইসরায়েল। প্রথমবারের মতো জেরুজালেম ইসরায়েলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে। সেখান থেকে বহু ফিলিস্তিনিকে বিতাড়িত করা হয়। এরপর থেকে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম মানুষের বাসের জন্য সীমাবদ্ধ করা হয়।

১৯৯৪ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উপস্থিতিতে ইসরায়েল ও জর্ডানের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়। ইসরায়েলের আরাভা উপত্যকায় তৎকালীন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন এবং জর্ডানের প্রধানমন্ত্রী আবদেল সালাম আল মাজালি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ইসরায়েলকে পশ্চিম তীরের এলাকা বাকুরা এবং ঘামার (আরবি ভাষায়) ইজারা দিতে সম্মত হয় জর্ডান। ২৫ বছরের জন্য দেওয়া লিজে ওই এলাকায় ইসরায়েলি কৃষকেরা চাষবাস করতে পারবেন বলে সম্মত হয় জর্ডান।

সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ওই শান্তিচুক্তির পর থেকে নিজেদের সীমান্ত বরাবর একটি করিডর পরিত্যক্তই রাখে ইসরায়েল। কারণ, ইসরায়েলের অংশের ওই এক ফালি জমি ভয়াবহ বিপজ্জনক হওয়ায় এখানে চাষবাসের কথা ভাবেইনি কেউ।

তবে এখন অনেক ইসরায়েলি কৃষক মনে করছেন, এক বছর পর জর্ডান সীমান্ত বরাবর দুটি অঞ্চল থেকে এক বছরের মধ্যে তাঁদের বিতাড়িত করা হবে। সম্প্রতি দ্য জেরুজালেম পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯৪ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে করা শান্তিচুক্তি আর নবায়ন করবে না জর্ডান। এ কারণে বাকুরা ও ঘামার অঞ্চল দুটি আর ইজারা পাবে না ইসরায়েল। ২৫ বছর ধরে এই দুই অঞ্চলের এক হাজার একর জমি চাষবাস করছেন ইসরায়েলের কৃষকেরা। চুক্তি অনুসারে ইসরায়েলের কাছে ২৫ বছরের জন্য ভূমি দুটি ইজারা দেয় জর্ডান।

জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ একটি টুইট বার্তায় বলেন, ‘বাকুরা ও ঘামার সব সময় আমাদের অগ্রাধিকারের শীর্ষে ছিল। তাই অঞ্চল দুটি ইজারা দেওয়ার চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। এই ভূমি দুটি জর্ডানের এবং জর্ডানবাসী এর ব্যবহার করবে।’

সম্প্রতি দেশটির পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, শান্তিচুক্তি শেষ করার বিষয়ে বাদশাহর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ইতিমধ্যে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ইজারা দেওয়ার চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে জর্ডানের সঙ্গে সমঝোতা করবে ইসরায়েল।

১৯৯৪ সালে চুক্তি হলেও ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকেই অঞ্চল দুটি দখলে রেখেছে ইসরায়েল। ১৯৯৪ সালের শান্তিচুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০১৯ সালের অক্টোবরে।

এমন অনিশ্চিত অবস্থায় পশুপাখির কথা ভেবে ভূমি অব্যবহৃত রাখা সম্ভব বলে মনে করছে না ইসরায়েল।

ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, তাঁরা এর মধ্যে যথেষ্ট ভূমি হারিয়েছেন। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে ওই এলাকা তাঁদের জন্য বন্ধ। কিন্তু সব সময় বিষয়টি সাময়িক হিসেবেই দেখেছেন তাঁরা। ফিলিস্তিনিরা মনে করেন, ইসরায়েলের পাশে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রই গড়ে উঠছে। কিন্তু এখন যদি ওই এলাকা প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে আর কখনোই ওখানে কৃষিকাজ করা যাবে না বলে আশঙ্কা করছেন ফিলিস্তিনিরাও। তাঁরাও চান না এখানে গড়ে উঠুক অভয়াশ্রম।