নাগরিকত্ব বিল বিজেপির শাঁখের করাত

ভারতের শাসক দল বিজেপির কাছে নাগরিকত্ব বিল শাঁখের করাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদর্শ ও নীতিগত দিক থেকে তো বটেই, রাজনৈতিক দিক দিয়েও বিলটি তাদের বড় সাধের। বাংলাদেশের নির্বাচন শেষ না হলে বিলটি পার্লামেন্টে ভোটাভুটির জন্য পেশ করা উচিত হবে কি না, দলীয় মহলে সেই চিন্তা উঁকি মারছে। পাশাপাশি তাদের বড় চিন্তা আসামের শরিক দল অসম গণ পরিষদকে (অগপ) নিয়ে। অগপ প্রকাশ্য হুমকি দিয়েছে, এই বিল পাস হলে তারা সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে।

লোকসভার ভোটের প্রচারের শুরু থেকেই বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব নাগরিকত্ব বিল নিয়ে তাঁদের প্রতিশ্রুতির কথা শুনিয়ে এসেছেন। ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, দলীয় সভাপতি অমিত শাহসহ শীর্ষ নেতারা বারবার বলেছেন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ‘অত্যাচারিত’ সংখ্যালঘু নাগরিকদের জন্য ভারতের দরজা খোলা থাকবে। এই তিন দেশের হিন্দু, খ্রিষ্টান, শিখ, জৈন, পার্সি, বৌদ্ধদের মতো সংখ্যালঘুদের ভারত নাগরিকত্ব দেবে। সে জন্য দেশের প্রচলিত নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করা হবে। নাগরিকত্ব পাওয়ার আগে এই সব মানুষ যাতে নিশ্চিন্তে ও নির্বিঘ্নে বসবাস করতে পারেন, সরকার তা নিশ্চিত করবে। এই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই বহু রাজ্যে সরকারি নির্দেশও জারি করা হয়েছে। এখন সরকার চায় সংশ্লিষ্ট বিলটিকে আইনে পরিণত করতে।

সমস্যা সেখানেই। প্রস্তাবিত বিলটি আপাতত যৌথ সংসদীয় কমিটির (জেপিসি) বিচার্য। লোকসভার ২০ জন ও রাজ্যসভার ১০ জন সদস্যকে নিয়ে এই জেপিসি গঠিত হয়েছে। চেয়ারম্যান বিজেপির রাজেন্দ্র আগরওয়াল। গত মঙ্গলবার জেপিসির বৈঠকে বিরোধীরা বিভিন্ন প্রশ্নে সরব হয়। ফলে বিলটির ধারা-উপধারাসহ খুঁটিনাটি বিষয়গুলো আলোচনা করা যায়নি। বিরোধীদের সম্মিলিত দাবির মুখে জেপিসির বৈঠক এক সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়া হয়। ২৭ নভেম্বর ফের বৈঠক বসবে। বিরোধীদের প্রস্তাব অনুযায়ী, বিল থেকে বাংলাদেশের নাম বাদ দেওয়া হবে কি না বা তিন দেশ থেকে চলে আসা ‘অত্যাচারিত’ সবাইকে ধর্ম-নির্বিশেষে স্থান দেওয়া হবে কি না, সেই প্রশ্নগুলো বিবেচিত হবে। বিবেচনা শেষে জেপিসি বিলটি চূড়ান্ত করলে তখন তা পার্লামেন্টে পেশ করা হবে ভোটাভুটির জন্য। সরকার আপাতত চিন্তিত এই নিয়েই।

চিন্তার একটা বড় কারণ বাংলাদেশের নির্বাচন। ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই নাগরিকত্ব বিল ভারতের পার্লামেন্টে পেশ করা উচিত হবে কি না, সে বিষয়টি ভেবে দেখা হচ্ছে।

বিজেপির একটি সূত্র অনুযায়ী, দলের যাঁরা বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে কাছ থেকে নিরীক্ষণ করছেন, তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশের ভোটের আগে এই বিষয়টি ভারতের পার্লামেন্টে আলোচিত হলে তাতে প্রতিবেশী দেশটিতে অন্য ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। মৌলবাদী ও ভারতবিরোধী অপশক্তি তা রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হবে। কাজেই, বাংলাদেশের ভোট কেটে গেলে বিলটি আলোচনায় নিয়ে আসা উপযুক্ত হবে। দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্কের কারণেই এই মহল পশ্চিমবঙ্গের নাম বদল করে ‘বাংলা’ রাখারও বিরোধিতা করে আসছে।

বিজেপি সূত্র অনুযায়ী, শাসকদলের একাংশ এই যুক্তিকে প্রণিধানযোগ্য বলে মনে করছে। ওই মহলের মতে, এতে বিলটি নিয়ে আলোচনার সময়ও পাওয়া যাবে বেশি। তাড়াহুড়া করতে হবে না। ভারতীয় পার্লামেন্টের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হচ্ছে ১১ ডিসেম্বর। চলবে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত।

বিজেপির অন্য বড় সমস্যা আসাম। ওই রাজ্যে তাদের শরিক দল অগপ নাগরিকত্ব বিলের বিরোধিতায় কোমর কষে নেমেছে। দলের শীর্ষ নেতারা জেপিসির বৈঠক শুরুর আগে সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে বিলটির বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন, বিজেপি বিলটি পাস করালে রাজ্যের মন্ত্রিসভা থেকে তাঁরা বেরিয়ে তো আসবেনই, বিজেপির বিরুদ্ধে জন-আন্দোলনও গড়ে তুলবেন।

আসামে নাগরিক পঞ্জি তৈরির বিষয়ে বিজেপি সেই রাজ্যের যে অংশের সমর্থন আদায় করেছে, নাগরিকত্ব বিল সেই অংশকেই আবার শঙ্কিত করে তুলেছে। তারা মনে করছে, এই বিল আইন হয়ে গেলে বাংলাদেশি হিন্দুরা দলে দলে চলে এসে ভূমিপুত্রদের ভিটেছাড়া করে তুলবে। এটা যদি একটা রাজনৈতিক সংকট হয়ে থাকে, কূটনৈতিক সংকট তা হলে বাংলাদেশকে ঘিরে। নাগরিক পঞ্জি চূড়ান্ত হয়ে গেলে ‘অনাগরিক’ ঘোষিত মানুষজনকে সে দেশে ফেরত পাঠানো নিয়ে নতুন সংকট সৃষ্টি হওয়ার একটা আশঙ্কা রয়েছে। ভারত যতই বলুক সমস্যাটা ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ’, বাংলাদেশ পুরোপুরি চিন্তামুক্ত নয়। এর ওপর সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রশ্নটি নতুন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। শুরু হতে পারে অভ্যন্তরীণ সমস্যা। আসাম ও বাংলাদেশকে ঘিরে নাগরিক পঞ্জি ও নাগরিকত্ব বিল বিজেপির কাছে তাই প্রকৃত অর্থেই শাঁখের করাত।