ইউরোপের নিজস্ব সেনাবাহিনীর স্বপ্ন দেখেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট

এমানুয়েল মাখোঁ। ছবি: রয়টার্স
এমানুয়েল মাখোঁ। ছবি: রয়টার্স

মার্কিন ছত্রচ্ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে ইউরোপের নিজস্ব সেনাবাহিনীর স্বপ্ন দেখেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। মার্কিন সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরতা কমানোর পক্ষেই যুক্তি দেন তিনি। নভেম্বরের শুরুতেই এক সাক্ষাৎকারে মাখোঁ তাঁর এ ইচ্ছার কথা বলেন। তাঁর ভাষ্য, ‘চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো আমাদের নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিজেদের করা উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ইউরোপের স্বয়ংক্রিয় কৌশলের দিকে যাওয়া উচিত। এ কৌশলের মধ্যে থাকতে পারে ‘ট্রু ইউরোপিয়ান আর্মি’ তৈরি করা।’

‘ট্রু ইউরোপিয়ান আর্মি’ বলতে ইউরোপের নিজস্ব সেনাবাহিনী গড়ার কথা বলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, মাখোঁর ওই কথার পরই তাঁর সুরে সুর মেলান জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলও।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ বা ব্রেক্সিট নিয়ে ইউরোপজুড়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলছে। ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার কথা। ব্রেক্সিটের পর ইউরোপের সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন ইউরোপের নেতারা। তাঁদের মধ্যে আছেন এমানুয়েল মাখোঁ ও ম্যার্কেল।

দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপের ফেডারেলিস্টরা প্রতিরক্ষা খাতে একযোগে কাজ করা স্বপ্ন দেখে আসছেন। কিন্তু আগ্রহ থাকলেও তাঁরা এ পথ মাড়াতে সাহস দেখাননি। এর আগে ১৯৫০ সালে ইউরোপের বাহিনী গড়ে ওঠার কথা উঠেছিল। সেবার ফ্রান্সের বিরোধিতার কারণেই সেটা সম্ভব হয়নি। বিরোধিতা করেছিল ব্রিটেনও। ব্রিটিশরা মনে করেছিল, এমন বাহিনী তৈরি হলে ন্যাটো ভেঙে যাবে কিংবা ফাটল ধরবে। এরপর থেকে ইউরোপের প্রতিরক্ষা কিংবা নিজস্ব বাহিনী গড়ার বিষয়টি খুব একটা আলোচনায় আসেনি।

এবার হুট করেই এটি আলোচনায় উঠে আসার মধ্যে তিনটি অন্যতম কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ব্রেক্সিট কার্যকর হলে ইইউয়ের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বাদ পড়বে। ইউরোপের বাইরে গেলে ইউরোপের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। আরেকটি হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর কারণে ন্যাটোতে ইইউয়ের আস্থা কমে গেছে। তৃতীয় কারণ, ফ্রান্স ও জার্মানি বিশেষ বাহিনী গড়ে তুলতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

ইইউয়ের নেতারা ‘ট্রু ইউরোপিয়ান আর্মি’র লক্ষ্যের বিষয়ে পরিষ্কার নন এখনো। অনেকের মনেই প্রশ্ন, এ বাহিনী কি ইইউয়ের দেশগুলোর সম্পর্ক আরও দৃঢ় করবে, নাকি ফ্রান্সের মিলিটারি পুলিশের আদলে একটি বাহিনী তৈরি হবে? এটি কি এমন একটি বাহিনী হবে, যেটি রাশিয়া কিংবা চীনের মতো শক্তিশালী দেশগুলোর বাহিনীকেও হারানোর ক্ষমতা রাখবে?

ইইউয়ের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা ব্যবহারে জার্মানির আগ্রহই বেশি। এসব ‘প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা’র মধ্যে স্থায়ীভাবে সহযোগিতা করার একটা গঠনপ্রণালি এবং ইউরোপের বড় ও ছোট দেশগুলোকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসা অন্যতম।

ফ্রান্স কী চায়? মাখোঁ চান, ইউরোপে এমন একটি সংগঠন কিংবা সংস্থা থাকবে, যারা আকারে ছোট হলেও বড় পরিসরে কাজ করার ক্ষমতা রাখবে। এ ক্ষেত্রে ইউরোপের বাইরে থাকা ছোট দেশগুলোও অংশ নিতে পারবে। ফরাসিদের এমন মনোভাবকে আবার অন্য চোখে দেখছে জার্মানি। জার্মানরা ভাবছে, এর মাধ্যমে ফ্রান্স আফ্রিকায় চলা যুদ্ধে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করবে। অন্যদিকে, এসব পরিকল্পনার ব্যয় বহন করতেই হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপ। এসবের কারণেই মাঝারি ধরনের যুদ্ধও আমেরিকার সাহায্য ছাড়া মোকাবিলা করতে পারে না ইউরোপ। ২০১১ সালের লিবিয়া যুদ্ধে এটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে ইউরোপ।

ইদানীং অবশ্য নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হয়েছে ইউরোপের দেশগুলো। সম্প্রতি নরওয়েতে ইইউ তাদের অস্ত্রের প্রদর্শনী করেছে। প্রদর্শনীতে অস্ত্র সজ্জিত গাড়ি, ট্যাংকার, যুদ্ধবিমানগুলো ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে জার্মানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন’–এর হিসাব বলছে ভিন্ন কথা। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, ইউরোপে এসব অস্ত্রের মজুত দিনকে দিন বাড়ছে না, বরং কমছেই। তারা বলছে, ইইউ থেকে ইংল্যান্ড বের হয়ে গেলে ইউরোপ আরও দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

এমন আশঙ্কার পর মাখোঁ ‘ইউরো ফোর্স’ গঠন করার স্বপ্ন দেখতেই পারেন। এতে ইউরোপের দেশগুলো অন্তত নিজেদের সেনাবাহিনীর শক্তি বাড়ানোয় মনোযোগী হবে। এ ক্ষেত্রে ডাচ, রোমানিয়ান ও চেক রিপাবলিকানদের জার্মান সেনাবাহিনীতে যুক্ত হওয়াটা আশা–জাগানিয়া। অন্তত ইইউয়ের জন্য হলেও। তবে ভয়ও আছে। এর ফলে ছোট ছোট যুদ্ধ বাধায় সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে, যা নিজের মিত্রদের বিষয়ে আমেরিকাকে খেপিয়ে তুলবে।

মাখোঁর ইউরোপীয় সেনাবাহিনীর প্রস্তাবের পর ট্রাম্প অবশ্য চুপ ছিলেন না। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের অবস্থান তুলে ধরে টুইট বার্তায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘এমানুয়েল মাখোঁ যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে ইউরোপকে রক্ষা করতে ইউরোপের নিজস্ব সেনাবাহিনী গড়ে তোলার কথা বলেছেন। কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির অবস্থান কী ছিল, তিনি ভুলে গেছেন?’ ন্যাটোতে ইউরোপে অর্থ সহায়তা বাড়ানোর দাবিও জানান ট্রাম্প।

ডিবেটিং ইউরোপ নামের একটি জরিপ সংস্থার তথ্যমতে, ইউরোপের বেশির ভাগ দেশই ইউরোপীয় সেনাবাহিনী গড়ার পক্ষে মত দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে জার্মানি, ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে সন্ত্রাসী হামলার পর সাধারণ ইউরোপিয়ানদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। এর সঙ্গে ইউরোপ থেকে ইংল্যান্ডের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তও ভাবিয়ে তুলছে ইউরোপের অনেক নাগরিককে।