খনিজ আহরণে অশান্ত সাগর!

সাগরের তলদেশে বিছিয়ে থাকা নোডিউল। ছবি: সি বেড মিনারেলস অথোরিটির সৌজন্যে
সাগরের তলদেশে বিছিয়ে থাকা নোডিউল। ছবি: সি বেড মিনারেলস অথোরিটির সৌজন্যে

ডিভা অ্যামন ২০১৩ সালে প্রথমবার একটি তিমির মাথার খুলি নিয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। লন্ডনের প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর দ্য ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের গবেষক তিনি। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরে হাওয়াই ও মেক্সিকোর মধ্যবর্তী সাড়ে চার মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ক্ল্যারিয়ন ক্লিপেরটন জোনে (সিসিজেড) বিশেষ অভিযানের সময় খুলিটি পাওয়া যায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চার হাজার মিটার গভীরে ধূসর কাদামাটিতে কালো আচ্ছাদনে মুড়িয়ে ছিল তিমির খুলিটি।

ইকোনমিস্ট সাময়িকীর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, খুলিটি থেকে নারী গবেষক অ্যামন উল্লেখযোগ্য দুটি তথ্য পান। এক. খুলিটির আচ্ছাদন দেখে বোঝা গিয়েছিল তা মিলিয়ন মিলিয়ন (এক মিলিয়ন = ১০ লাখ) বছরের পুরোনো। খুলির ওপর দীর্ঘ সময় ধরে বিন্যস্ত ধাতব অক্সাইড খনিজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। দুই. গভীর সমুদ্র সম্পর্কে আমরা কতই–না কম জানি! সেই সঙ্গে বিষয়টি এমন প্রশ্ন সামনে এনেছে যে অর্থনৈতিক লাভের জন্য সাগরের তলদেশ থেকে খনিজ আহরণের পরিবেশগত প্রভাব কতটুকু?

সাগরের তলদেশের খনিজ উত্তোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের আশা, এটা শত শত কোটি ডলারের শিল্পে পরিণত হবে। সাগরের তলদেশের ছোট ছোট আকৃতির নানা ধরনের ধাতব মিশ্রণের টুকরোগুলোয় (সি বেড পলি মেটালিক নোডিউলস) লৌহ ও ম্যাঙ্গানিজের মিশ্রণ রয়েছে। ম্যাঙ্গানিজ তুলনামূলক দুর্লভ ধাতু হলেও শুকনো ভূমির খনি থেকে যে এটা পাওয়া যায় না, তা নয়। নোডিউলে কপার, নিকেল ও কোবাল্ট এবং কখনো কখনো মলিবডেনাম ও ভ্যানাডিয়াম ধাতুও থাকে। দারুণ ব্যবসায়িক লাভ থাকায় এসব ধাতুর জন্য সাগর সেচতে এত আগ্রহ খনিজীবীদের। গভীর সমুদ্রের তেমনই এক খনি প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল সি মিনারেল রিসোর্সেসের (জিএসআর) কর্মী ক্রিস ভ্যান নিজেনের ভাষায়, একই শ্রম দিয়ে একই ধাতু পেতে ভূমিতে দুই–তিনটি খনি খুঁড়তে হয়।

আপাতদৃষ্টিতে সাগরের গভীর থেকে নোডিউল আহরণ কঠিন বলে মনে হলেও অন্যভাবে বলা যায়, কাজটি তুলনামূলক সহজ। সাগরের তলদেশে বিছিয়ে থাকা নোডিউল যেন খনিজীবীদের হাতে ওঠার জন্যই অপেক্ষা করে থাকে। ২০০১ নটিক্যাল মাইলের বাইরে উপকূলীয় দেশগুলোর জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ক্ল্যারিয়ন ক্লিপেরটন জোনের মতো সাগর এলাকায় বেশির ভাগ নোডিউল পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক সি বেড অথোরিটি (আইএসএ) এই খনিজ সম্পদ আহরণে ১৭টি লাইসেন্স দিয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপের কয়েকটি দেশের পাশাপাশি বেলজিয়াম, ব্রিটেন, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, জাপান, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া এই লাইসেন্স পেয়েছে। আইএসএ প্রণীত সমুদ্র আইন নিয়ে জাতিসংঘ কনভেনশনের কোনো পক্ষ না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এই সম্পদ আহরণ করতে পারে না। তবে ব্রিটেনের সি বেড রিসোর্সেস প্রতিষ্ঠানের ভর্তুকিতে লকহিড মার্টিন নামের একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ভূমিতে খনির যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হচ্ছে, পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছে। জীববিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এমন কর্মযজ্ঞের পুরোটাই যদি খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য হয়, তবে যথাযথভাবে শ্রেণিবিন্যাস করে কাজটি না করলে তা সাগরের বাসিন্দাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

সে ক্ষেত্রে প্রথম কাজই করতে হবে সাগরে আসলে কোন কোন প্রাণী বসবাস করছে, তা শ্রেণিভুক্ত করা। এক ঝলকে ক্ল্যারিয়ন ক্লিপেরটন জোনের গভীর সমুদ্রের তলদেশকে আকর্ষণীয় কিছু মনে হয় না। শুধু কাদামাটি আর নোডিউল দেখা যায়। তবে অঞ্চলটিতে প্রচুর প্রাণের দেখা না মিললেও বৈচিত্র্য রয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ের সমুদ্রবিজ্ঞানী ড. ক্রিগ স্মিথ বলেছেন, ক্যালিফোর্নিয়া ও হাওয়াইয়ের চেয়ে ক্ল্যারিয়র ক্লিপারটন জোনে জীববৈচিত্র্য বেশি। সেখানে কল্পনার বাইরেও কিছু প্রাণীর দেখা মেলে। একেকটা উদ্ভট আকারের। কোনোটা আঠালো, কোনোটার লম্বা–চওড়া লেজ রয়েছে। দানবাকৃতির ৪০ সেন্টিমিটার লম্বা লাল চিংড়ি রয়েছে। চোখের ওপর কানের মতো পাখাওয়ালা ‘ডাম্বো’ অক্টোপাস রয়েছে, কার্টুনের হাতির সঙ্গেই এর মিল পাওয়া যায়।

সাগরের প্রতিটি অভিযানে বিজ্ঞানের এমন নতুন নতুন প্রজাতি উঠে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের মন্টেরেতে সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে ড. স্মিথ জীববৈচিত্র্যের এক জরিপের তথ্য তুলে ধরেন। তিনি জানান, ক্ল্যারিয়ন ক্লিপেরটন জোনে ১৫৪টি ব্রিসল ওয়ার্মসের (একধরনের কৃমি) সন্ধান পাওয়া গেছে, এগুলোর ৭০ শতাংশই অজানা।

মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের চার হাজার মিটার গভীরে সাগরের তলদেশ ঢেকে আছে নোডিউলে। ছবি: ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ের সৌজন্যে
মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের চার হাজার মিটার গভীরে সাগরের তলদেশ ঢেকে আছে নোডিউলে। ছবি: ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ের সৌজন্যে

মন্টেরে সম্মেলনে ড.অ্যামন জানান, ক্ল্যারিয়ন ক্লিপেরটন জোনে তিমির বড় ধরনের জীবাশ্ম রয়েছে। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর একটি গবেষক যান ১৮৭০ সালে গভীর সমুদ্রে প্রথমবার তিমির জীবাশ্ম দেখতে পায়। ২০১৩ সালে সেই ধরনের জীবাশ্মের সন্ধান পান ড. অ্যামন। তাঁর সহকর্মীরা গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান চালানো বিভিন্ন সাবমেরিনের হাজার হাজার ছবি সংগ্রহ করেন। তিমি গোত্রের ৫৪৮টি জীবাশ্ম এতে রেকর্ড হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো জীবাশ্ম ছিল চোনেজিফিয়াসের। তিমি গোত্রীয় এই প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে, ১০০ কোটি বছর আগে এদের বসবাস ছিল।

সরাসরি দেহাংশ ছাড়া শুধু ছবির ওপর ভিত্তি করে এই গবেষণা চালানো হয়েছে বলে কোনো কোনোটি শনাক্ত করার ক্ষেত্রে সন্দেহ রয়ে গেছে। ধাতব অক্সাইডে ঢেকে থাকা অনেক হাড় থেকে বোঝা যায়, এগুলোর বয়স কত।

বিজ্ঞানীদের মতে, সাগরের তলদেশ থেকে খনিজ উত্তোলনের সময় সমুদ্রের প্রাণীদের কথাও ভাবা উচিত। শুধু অর্থনৈতিক লাভের বিষয়টি মাথায় না রেখে জীববৈচিত্র্যের কথাও ভাবতে হবে। ভূমিতে পাওয়া খনিজ সম্পদের মতো সমপরিমাণ খনিজ সমুদ্র থেকে উত্তোলনের প্রভাবের ব্যাপারে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। ক্ল্যারিয়ন ক্লিপেরটন জোন গভীর সমুদ্রের মাত্র ২ শতাংশ। খনিজীবী ভ্যান নিজেনের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০ বছরের খনিজ উত্তোলন কার্যক্রমের কারণে এই অঞ্চলের ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে।

জানা গেছে, খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কারণে সাগরের তলদেশে কী পরিবর্তন এসেছে, তা পরিমাপের জন্য ছোট আকারের পাইলট কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি শুরু হবে এপ্রিলে। পাটানিয়া ২ নামের নোডিউল সংগ্রাহক ট্রাক্টরের মাধ্যমে সাগরের তলদেশের কিছু জায়গা নোডিউল মুক্ত করে ফেলা হবে, পরবর্তী সময়ে অভিযানকারীরা ওই স্থান পর্যবেক্ষণ করবেন। কোনো স্থানে নোডিউল থাকা না থাকার ফলাফল বোঝার চেষ্টা করবেন তাঁরা। তবে খনিজীবীদের সতর্ক থাকতে হবে, ক্ল্যারিয়ন ক্লিপেরটন জোনে লাখ লাখ বছর ধরে বসবাসকারী প্রাণীরা এখন আর তত শান্তিতে নেই।