গরম-গরম ভুয়া খবর

আসল–নকলের ভিড়ে ভুয়া খবরে বিভ্রান্ত হন পাঠক। ছবি: এএফপি
আসল–নকলের ভিড়ে ভুয়া খবরে বিভ্রান্ত হন পাঠক। ছবি: এএফপি

নায়করাজ রাজ্জাকের মৃত্যুর আগেই ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি নেই। রাজ্জাক তখন অসুস্থ। তাই খবরটা প্রসব করে মাটিতেও পড়তে পারেনি। ঝোড়োবেগে সামাজিক যোগাযোগ দুনিয়ায় মাতম তোলে। ভক্তরা মুষড়ে পড়েন। পরে দেখা গেল সবই ভুয়া।


অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান মারা গেছেন বলেও একসময় খবর ছড়িয়ে পড়ে। অনেক পাঠক সংবাদমাধ্যমগুলোতেও ফোন করা শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত এ টি এম শামসুজ্জামানকেই বলতে হয়েছিল, তিনি মারা যাননি, বেঁচে রয়েছেন।


এই তো, কিছুদিন আগে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা প্রবেশের ছবিকে উল্টিয়ে দেখিয়ে মিয়ানমার সরকার খবর ছড়িয়েছিল বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা দলে দলে মিয়ানমারে ফিরছে। এক দেশের গণহত্যার ছবি অন্য দেশের বিক্ষোভ আন্দোলনে চালিয়ে দেওয়ার ঘটনা তো হরহামেশাই চলছে। বাংলাদেশেই এমন হয়েছে কয়েকবার। নির্বাচনের আগে আগে ভুয়া খবরের পরিমাণও বেড়ে যায়। গত সপ্তাহে তাইওয়ানে স্থানীয় নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য ক্ষমতাসীনেরা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়া ভুয়া খবরকে দায়ী করেছেন। ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এমন ভুয়া খবর নিয়ে তো রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন। কারণ, ভুয়া খবরের খড়্গ তাঁর ওপরেই বেশি পড়েছে। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ নিজেও ওই সময় ফেসবুকে ভুয়া খবর ভাইরাল হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

ভুয়া খবরের আরেক রূপের জবরদস্ত নাম হলো স্যাটায়ার। অনিয়ন নামের একটি সাইট স্যাটায়ারের জন্য খ্যাতনামা। অনেকে না বুঝে সেই সাইটের খবর বিশ্বাস করে ফেলেন। ওই সাইটের দুটো ভুয়া খবর বাংলাদেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমে ‘ভুলে’ প্রকাশও হয়েছিল। ভোট প্রতারণা, অভিবাসন ও ইসলাম—এ বিষয়গুলো হলো ভুয়া খবরের দুনিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়বস্তু।

কেন এই ভুয়া খবর ছড়ানো হয়? কারা করেন কাজটি?

মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায়, যে বিষয়ে মানুষের অসন্তোষ রয়েছে, সেসব বিষয়ে নেতিবাচক খবর পেতে পছন্দ করার প্রবণতা রয়েছে মানুষের মধ্যে। যেমন সরকারের বিরুদ্ধে বা কোনো রাজনৈতিক দল বা তারকার বিরুদ্ধে কোনো ভুয়া খবর প্রকাশিত হলে তা যাচাই করার পেছনে শ্রম নষ্ট না করে তাতে বিশ্বাস রাখতে চায় মানুষ।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তব জীবনে ধাক্কা লাগার মতো ঘটনা খুব একটা ঘটে না। রোজকার গতানুগতিক জীবনযাপনের বাইরে তাই কাল্পনিক খবরগুলো একধরনের উত্তেজনা তৈরি করে। কৌতূহলী মন উত্তেজনা পছন্দ করে। একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে ভুয়া খবরের চমকটা সহজে পছন্দ করে ফেলে মানুষ।


ভুয়া খবর পছন্দ করার ক্ষেত্রে যেসব প্রবণতা কাজ করে, এর মধ্যে হীনম্মন্যতা অন্যতম বলে মনে করেন এই মনোবিজ্ঞানী। তিনি বলেন, মানুষ অনেক ধরনের সংকটের মধ্যে থাকে। তাই আরেকজনের সংকট তাকে একধরনের স্বস্তি দেয়। নিজের অসন্তোষ থেকে ভুয়া খবর বিশ্বাস করে সে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংস অভিযানের পর গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করে। ছবি: রয়টার্স
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংস অভিযানের পর গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করে। ছবি: রয়টার্স

ভুয়া খবর লেখেন—এমন দুজনকে নিয়ে একটি প্রতিবেদনও ছাপিয়েছে বিবিসি। ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে—কেন ও কীভাবে তাঁর ভুয়া খবর লেখেন এবং তা ছড়িয়ে দেন।


তেমন একজন ভুয়া খবর লেখক পরিবেশক ক্রিস্টোফার ব্লেয়ার। তাঁর নিয়মিত কাজ হলো কফির কাপে চুমুক দিয়ে সামনে খুলে রাখা তিনটি স্ক্রিনের একটির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। যেখানে বসে তিনি কাজ করেন, সেটি তাঁর বাড়ি কাম অফিস। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে মেইন অঙ্গরাজ্যের সবচেয়ে বড় শহর পোর্টল্যান্ড থেকে ৪৫ মিনিট দূরে তাঁর এই বাড়ি কাম অফিস। কফিটা ঠান্ডা হওয়ার আগে তাতে আরেক চুমুক দিয়ে মনোনিবেশ করেন তাঁর অনেকগুলো ওয়েবসাইটের একটিতে।

একেক দিন একেকটি ইস্যু তিনি বেছে নেন। সেটা হতে পারে বির্তর্কিত কোনো ঘটনা, অপরাধ, নতুন আইন বা সংবিধান সংশোধনের বিষয়। মার্কিন সংবিধান ‘পরির্বতন’ তো এখন তাঁর কাছে মজার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যে তিনি ৩০টিরও বেশি ভুয়া সংশোধন লিখেছেন। অথচ প্রকৃত সংশোধন রয়েছে মাত্র ২৭টি।

আজ কী বেছে নেবেন তিনি? কে সেই ‘সৌভাগ্যবান’ রাজনীতিবিদ, যিনি আজ ক্রিস্টোফার ব্লেয়ারের মনোযোগ কাড়বেন? বিল ক্লিনটন? হিলারি ক্লিনটন? নাকি কোনো একজন ওবামা? তবে বিষয়বস্ত একজন ব্যক্তি নাও হতে পারেন। কোনো নীতি হতে পারে সেটা। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ? পুলিশের নিষ্ঠুরতা? নারীবাদিতা? অথবা আর কিছু?
তাঁর একটি ব্রেকিং খবরের কথা ধরা যাক। যেটাতে লিখেছিলেন, ‘মাদক, অস্ত্র ও যৌনদাস সহকারে বাল্টিমোর বন্দরে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের জাহাজ আটক’। খবর হিসেবে দারুণ চমকপ্রদ বলা যায়। তবে যে শব্দগুলো তিনি ব্রেকিং খবর হিসেবে পরিবেশন করেছিলেন, সে ব্যাপারে তাঁর কাছে কোনো তথ্য ছিল না, অনুসন্ধানও ছিল না। যা লিখেছিলেন, তা মনগড়া। কিবোর্ডের ওপর আঙুলের ছন্দে বেরিয়ে আসে অক্ষর। অক্ষরগুলো থেকে তৈরি হয় বাক্য। এটি লিখতেও যেমন বেশি সময় লাগে না, তেমনি প্রকাশ করতেও।

এমন যেকোনো খবর প্রকাশ করে ব্লেয়ার আরাম করে তাঁর চেয়ারে হেলান দেন। খবরটি এখন কত লাইক ও শেয়ার হয়, তা দেখে যাওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনো কাজ নেই।

এবার আসুন আরেকজনের গল্প শুনি। ব্লেয়ারের মতো তাঁরটিও বাসা কাম অফিস। তবে স্থান এক নয়। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের পূর্বে এক ঘণ্টার দূরত্বের পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরে ছোট শহরে তাঁর অবস্থান। এটা যাঁর বাসা কাম অফিস তাঁর নাম মার্টেন শ্যাংক। ব্লেয়ারের মতোই তাঁর ডেস্ক। তাতে তিনটি কম্পিউটার। এর একটি স্ক্রিনের দিকে নজর গেল তাঁর। একটি বিষয় ঘিরে অনেক কার্যকলাপ শুরু হয়েছে দেখতে পেলেন। একটি নির্দিষ্ট খবরের দিকে লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে ধুমিয়ে শেয়ার দিচ্ছে।

মার্টেন শ্যাংক তাঁর নিজের ওয়েবসাইটে ঢুকে টাইপ করা শুরু করলেন। তাঁর কাজ হলো ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের জাহাজ আটকের ভাইরাল খবরটি সম্পর্কে বিশ্বকে বলা।
নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এভাবে জন্ম নেয় একটি ভুয়া খবর এবং তা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া।

২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাংবাদিকেরা লক্ষ করা শুরু করেন, ফেসবুকে হঠকারী নিউজের ছড়াছড়ি। এক ভুয়া সংবাদদাতার (ফেকার) ভাষায়, ‘আমেরিকানরা আমাদের গল্পগুলো পছন্দ করে এবং আমরা এ থেকে টাকা বানাই। ওই সব খবর সত্য না মিথ্যা, তা কে দেখে?’

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভুয়া খবর লেখকদের একজন ক্রিস্টোফার ব্লেয়ার। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভুয়া খবর লেখকদের একজন ক্রিস্টোফার ব্লেয়ার। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমজুড়ে ভুয়া খবরের ছড়াছড়ি নিয়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে হিলারি ক্লিনটন এক বক্তব্যে ‘বিদ্বেষপূর্ণ ভুয়া খবর ও অপপ্রচারের মহামারি’ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘এটি এখন স্পষ্ট যে কথিত ভুয়া খবরের প্রভাব রয়েছে বাস্তব জগতে।’


তবে হিলারি ক্লিনটনের ওই মন্তব্যে তাৎক্ষণিকভাবে ঠিকঠাক ব্যাখ্যা হয়নি। তিনি নির্বাচন ঘিরে যে সেই মন্তব্য করেছিলেন, তা বোঝা গিয়েছিল অনেক পরে। কয়েকজন সাংবাদিক তাঁর বক্তব্যকে ওয়াশিংটন ডিসির এক রেস্টুরেন্টে বন্দুকধারীর হামলার ঘটনার সঙ্গে মিলিয়েছিলেন। ট্রাম্প শিবির হিলারির সেই মন্তব্যকে কয়েক সপ্তাহ পর সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে ব্যবহার করেছিল।


অনেক সময় স্যাটায়ার ও প্যারোডির আদলেও ‘ভুয়া খবর’ পরিবেশন করা হয়। আপাতদৃষ্টিতে তা নিরীহ মনে হলেও তা লোকজনকে বোকা বানাতে পারে।

ব্লেয়ার ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের বোস্টনের এক শহরতলিতে বেড়ে উঠেছেন। তাঁর সৎবাবা ডেমোক্র্যাটের নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক। একবার ম্যাসাচুসেটস সিনেটে ডেমোক্র্যাটের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন তিনি। ব্লেয়ার দুই দশকের বেশি সময় নির্মাণকাজে যুক্ত ছিলেন। ২০০০ সালের শেষ দিকে নির্মাণ ব্যবসায় ধস নামলে তাঁর প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক ব্লগিং মাধ্যমে তিনি অর্থ আয়ের উপায় খুঁজতে থাকেন।

শুরুর কথা বলতে গিয়ে ব্লেয়ার জানান, তিনি লিখতে ভালোবাসেন। শব্দ কেমন জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে, সেই বিচক্ষণতা তাঁর ছিল। তিনি ব্লগে লেখা শুরু করলেন। দেখলেন, এখানে মন খুলে যা খুশি তা লেখা যায়। শুরুতে এটা মজা হিসেবেই ছিল। অল্প কিছু লোক পড়তেন। তবে ব্লগিং থেকে কোনো অর্থ উপার্জন হয় না। তাই তিনি ভিন্ন পন্থা নিলেন। তিনি বানিয়ে বানিয়ে লেখা শুরু করলেন, যেগুলো সত্যিকারের খবরের শিরোনামের মতো মনে হতো। দেখলেন, অনলাইনে তাঁর লেখা শত শত হাজার হাজার লাইক শেয়ার হচ্ছে। ব্লেয়ারের মতামত ও প্রকৃত লেখার চেয়ে তাঁর বানানো ভুয়া খবরে বেশিসংখ্যক লোক আগ্রহ দেখানো শুরু করে।

তবে সবাই পছন্দ করে তা কিন্তু নয়। যেমন তাঁর স্ত্রী, তিনি বেশ বিরক্ত ব্লেয়ারের এই বিষয়টি নিয়ে। ব্লেয়ারকে তিনি বলেন, ‘তুমি খামাখা সময় নষ্ট করছ। এসব তোমাকে কিছুই দেবে না।’

তবে তাঁর ভুয়া খবর ক্লিক হওয়া শুরু করলে তিনি গুগলের বিজ্ঞাপন প্ল্যাটফর্মে তা নিয়ে পেজভিউ থেকে অর্থ উপার্জন শুরু করেন। ২০১৪ সালে তিনি নিয়মিত চাকরি ছেড়ে দেন। অনলাইনে তিনি বুস্টা ট্রল, ফ্ল্যাগ ইগলটন—এমন সব ছদ্মনামে লেখা শুরু করেন।

প্রেসিডেন্ট ওবামা, লিবারেল, নারীবাদী, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন এবং অন্যান্য যেসব বিষয়ে লোকজন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাতে চাইত, সেগুলো তিনি বেছে নিতেন। ওই লোকজন অসত্য খবরগুলো বেছে নিতেন, শেয়ার করতেন যেন সেগুলো প্রকৃত খবরের ওয়েবসাইট থেকে এসেছে। এই সফলতা থেকে ব্লেয়ার ফেসবুকে আমেরিকা’স লাস্ট লাইন অব ডিফেন্স নামের পেজ খুলেন। গোঁড়া রিপাবলিকান ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের উদ্দেশ্য করে ভুয়া খবরগুলো পরিবেশন করা হয় ওই পেজে। সেই সব খবরের শিরোনাম থাকত সংবেদনশীল, কখনো কখনো আপত্তিকর।

ব্লেয়ার নিজেই সেসব শিরোনামকে ‘বর্নবাদী ও গোঁড়ামিপূর্ণ’ বলে মনে করেন। কিন্তু সেগুলোই ভাইরাল হয়। প্রতি ক্লিকে তাঁর হাতে উঠে আসে অর্থ।

ফিরে যাই বেলজিয়ামের কম্পিউটার প্রোগ্রামার মার্টেন শ্যাংক গল্পে। মার্টেন এমন একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছেন, যা নির্ণয় করতে পারে ফেসবুকের কোন খবরগুলোর দিকে এখন মানুষের ঝোঁক রয়েছে। তিনি এটাকে ট্রেন্ডোলাইজার বলেন। তিনি পরে সেসব বিষয়ের ওপর তাঁর ব্লগে লেখেন। তবে সেসব লেখার পাঠক পেতে তাঁকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে। ব্লেয়ারের মতো মার্টেনও আবিষ্কার করলেন কিছু মানুষ সত্য ভেবে কাল্পনিক খবরগুলো পড়তে পছন্দ করেন। ব্লেয়ারের মতো অত না হলেও মার্টেন ভুয়া খবর ছড়িয়ে কম অর্থ উপার্জন করেন না। তাঁর ‘লিড স্টোরিজ’ নামের ব্লগ ট্যাগলাইনসহ ভুয়া খবর ছড়ায়।

অনলাইনে ফেক খবরের ক্ষেত্রে ধাঁচ ও একই খবর বার বার প্রচার হওয়ার বিষয়টিও লক্ষ্য করেন মার্টেন। তিনি জানান, একবার সপ্তাহের পর সপ্তাহ তিনি হিলারি ক্লিনটনের মৃত্যুর খবর পেতেন। প্রায় প্রতি শনিবার তিনি এই খবর পড়তেন যে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি বেলুন দুর্ঘটনা বা নৌকা দুঘর্টনা বা হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন অথবা দানবাকৃতির ট্রাকের টায়ারের নিচে মাথাচাপা পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তিনি আরও লক্ষ করেন, ভুয়া খবরের দুনিয়ায় ওয়েবসাইটের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, তারা অন্য ভুয়া সাইট থেকে খবর চুরি করে। কপি পেস্ট করে চালিয়ে দেয় নিজেদের সাইটে। এর মধ্যে অনেকগুলো খবরের কপি পেস্ট হয়েছে একটি উৎস থেকে। আর সেই উৎস হলো ক্রিস্টোফার ব্লেয়ার। ভোট প্রতারণা, অভিবাসন ও ইসলাম—এ বিষয়গুলো হলো ভুয়া খবরের দুনিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়।

২০১৭ সালের শুরুতে ফেসবুকে ভুয়া খবর ভাইরাল হওয়ার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। তাই বলে যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এসব খবর ঠেকাতে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে তা কিন্তু নয়।


ফেসবুকে ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়ার খবরের সত্যতা স্বীকার করেছেন এর প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ। ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর তিনি বলেছিলেন, ভুয়া খবর ভোটারদের দোদুল্যমান করে। এটা নানাভাবে নির্বাচনে প্রভাব ফেলে। এটা একধরনের পাগলাটে ধারণা।

ভুয়া খবর লিখে অর্থ উপার্জন করছেন মার্টেন শ্যাংক। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
ভুয়া খবর লিখে অর্থ উপার্জন করছেন মার্টেন শ্যাংক। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

ভুয়া খবর লেখার জন্য এখন লেখক ভাড়া করেন ব্লেয়ার। তবে সুদিন বেশি সময় স্থায়ী হয় না। রাজনৈতিক বাতাস এখন ব্লেয়ারের বিপক্ষে। উদারপন্থী ডেমোক্র্যাট হলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পক্ষে এমন সব ভুয়া খবর পরিবেশনের জন্য তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ অনেক ডেমোক্র্যাট–সমর্থক।


আর একটি ভুয়া খবরে ব্লেয়ার নিজেই অনুতপ্ত। ওই লেখা সরিয়ে নিয়ে তিনি ক্ষমাও চেয়েছেন। ওই ভুয়া খবর ছিল টেক্সাসের। গত বছরের আগস্টে টেক্সাসে হারিকেন হার্ভে আঘাত হানলে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হয়। ওই সময় ব্লেয়ার একটি খবর লেখেন, এতে বলা হয়, টেক্সাসের এক মসজিদের ইমাম ঝড়ের সময় অমুসলিমদের আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আসলে ইমাম ও ওই মসজিদ দুটোই ছিল কাল্পনিক। তবে খবরে যে ব্যক্তির ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল, দুঘর্টনাবশত ওই ব্যক্তি ছিলেন কানাডার এক মসজিদের সত্যিকারের ইমাম। ইব্রাহিম হিন্দি নামের ওই ইমাম কখনো টেক্সাসে যানওনি। অথচ তিনি ভুয়া খবরের লক্ষ্যে পরিণত হন।
ব্লেয়ার বলেন, ‘ওই ঘটনায় আমি সত্যি খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। আমি তাৎক্ষণিকভাবে সেই খবর সরিয়ে নিই এবং তাঁর কাছে লাখোবার দুঃখ প্রকাশ করি।’

এমন আরেক ঘটনায় ব্লেয়ারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মার্টেন।


ব্লেয়ারের ভাষায়, স্যাটায়ার কোনো খবর নয়, মতামত নয়, অপপ্রচারও নয়। তিনি বলেন, তাঁর খবরগুলোকে স্যাটায়ার হিসেবে আনতে চান তিনি। যেন খবরটি সত্যি নয়, তা নিশ্চিত হয়েই লোকজন পড়েন। তিনি জানান, বিশ্বখ্যাত স্যাটায়ার সাইট অনিয়নের চেয়েও তাঁর কিছু পেজের খবরের প্রতিবাদ জানিয়েছেন খ্যাতনামা অনেকে।
বেলজিয়ামে মার্টেন এই ইুঁদর-বিড়াল খেলায় দিনে দিনে আরও বেশি মেতে উঠেছেন। মার্টেন বলেন, ভুয়া খবর যে পরিমাণ রয়েছে, সে তুলনায় তথ্য যাচাইয়ের ব্যবস্থা অনেক কম। তাঁর মতে, আনুমানিক ২০০টি ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা রয়েছে, যারা খবরের সত্যতা যাচাই করে। এটা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, যত দিন পর্যন্ত ভুয়া খবর লাভজনক থাকবে, তত দিন ভুয়া খবরের লেখকেরা লিখেই যাবেন। ভুয়া খবর ঠেকাতে নতুন নতুন ফিল্টার আসবে, আর ফিল্টার এড়িয়ে লেখার কৌশলও বের করতে থাকবেন লেখকেরা।