খাসোগি হত্যায় ১১ বার্তা পাঠান সৌদি যুবরাজ

সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: এএফপি
সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: এএফপি

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বর্তমানে জি-২০ সম্মেলনে অংশ নিতে আর্জেন্টিনায় আছেন। তুরস্কে সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার ঘটনা নিয়ে বিশ্ব জনমত যুবরাজ সালমানের বিরুদ্ধে। দেশের ভেতরেও যুবরাজের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গঠিত হয়েছে। সেই সময়ে জানা গেল, খাসোগি হত্যায় সালমান নিজের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাকে ১১টি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। গত ২ অক্টোবর হত্যার কয়েক ঘণ্টা আগে ও পরে উপদেষ্টা সৌদ আল-কাহতানিকে বার্তাগুলো পাঠান। সালমানের ওই উপদেষ্টা হত্যা মিশনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারীর দায়িত্বে ছিলেন।

মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে শনিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে এসব তথ্য জানিয়েছে চীনের সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট ও আল–জাজিরা। মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর ‘ক্লাসিফায়েড’ মূল্যায়নের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংস্থাটি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের নানান মূল্যায়ন পর্যবেক্ষণ করেছে। তথ্যগুলোকে তারা অতিমাত্রার গোপনীয় বলে বর্ণনা করছে। ওই সব গোপনীয় উদ্ধৃতি বিশ্লেষণ দেখা গেছে, যুবরাজ সালমান ও তাঁর উপদেষ্টা সৌদ আল-কাহতানির মধ্যে বার্তা আদান-প্রদান হয়। মোট ১১টি বার্তা আদান–প্রদান হয়। তবে বার্তাগুলোয় কী লেখা ছিল, তা প্রকাশ না করে সিআইএ বলছে, যুবরাজ সালমান সরাসরি জামাল খাসোগিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন কি না, সে তথ্য তাদের কাছে নেই।

অতি গোপনীয় গোয়েন্দা নথির বরাত দিয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমটি জানিয়েছে। তবে বার্তাগুলোর বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রতিবেদনে কিছু বলা হয়নি। মোহাম্মদ বিন সালমান সরাসরি খাসোগিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন এমন কথাও বলা হয়নি।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে খাসোগিকে হত্যা মিশনে ১৫ সদস্যের দলটির প্রধানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল আল কাহতানির। তবে সৌদি যুবরাজের অনুমতি ছাড়া এই হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মূল্যায়ন করা ওই বার্তাগুলোয় লেখা আছে, ‘এটা খুব স্পষ্ট, যুবরাজ সালমান সরাসরি এ হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন কি না, এ রকম কোনো তথ্য আমাদের হাতে এখনও আসেনি।’

মূল্যায়ন প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, খাসোগি হত্যায় জড়িত ১৫ সদস্যের ওই নেতৃত্বদানকারী যুবরাজের উপদেষ্টা কাহতানির সঙ্গে ইস্তাম্বুলে অবস্থানকারী হত্যা মিশনের প্রধানের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। তারা বলছে, ‘আমরা সব কিছু মূল্যায়ন করে এটা ভালোভাবে বুঝতে পারছি, যুবরাজ সালমানের অনুমোদন ছাড়া হত্যার এ রকম একটি অভিযান চালানোর সাহস রাখেন না তাঁরা।’

সিআইএর মূল্যায়নে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের আগস্টে যুবরাজ সালমান তাঁর সহযোগীদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন, খাসোগিকে যদি সৌদি আরবে ফিরিয়ে আনা না যায়, তাহলে অন্য কোনো দেশে প্রলোভন দেখিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। খাসোগি হত্যাকাণ্ডটি ওই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বলে মনে করে সিআইএ।

খাসোগি হত্যার পর ঘটনার তদন্ত শেষে সিআইএ বলেছিল, এ হত্যার পেছনে রয়েছে সৌদি রাজতন্ত্রের ওপর মহলের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা। তাঁদের ধারণা, রাজতন্ত্রের ওই বড়কর্তা হলেন যুবরাজ সালমান। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিআইএর এই তদন্তের ওপর সন্দেহ প্রকাশ করেন।

ঘটনার ১৭ দিন পর ‘হাতাহাতির একপর্যায়ে খাসোগির মৃত্যু’ হয়েছে বলে বিবৃতি দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এর আগ পর্যন্ত ঘটনার ব্যাপারে টানা অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিল দেশটি। এটা নিয়ে বিশ্বে নানান সমালোচনার মুখে পড়েন সৌদি রাজপরিবার। ক্ষোভ বাড়তে থাকে বিশ্বে।

২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে ব্যক্তিগত কাগজপত্র আনার প্রয়োজনে ঢোকার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন সৌদির খ্যাতনামা সাংবাদিক খাসোগি। শুরু থেকে তুরস্ক দাবি করে আসছে, খাসোগিকে কনস্যুলেট ভবনের ভেতর সৌদি চরেরা হত্যা করেছে। গত বছর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতা গ্রহণের পর রোষানলে পড়েন খাসোগি। তিনি দেশ ছেড়ে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ওয়াশিংটন পোস্টে যুবরাজ মোহাম্মদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে একের পর এক কলাম লেখেন। অভিযোগ উঠেছে, যুবরাজের নির্দেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এ হত্যা সংঘটিত হয়েছে।

খাসোগির পোশাক পরে অন্য কর্মকর্তা বের হন
জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ‘নতুন তথ্য’ দিয়েছিলেন সৌদি আরবের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। ১৫ জন সৌদি কর্মকর্তার ইস্তাম্বুল যাওয়া, খাসোগিকে কনস্যুলেটের ভেতরে ভয়ভীতি দেখানো এবং প্রতিরোধের মুখে টুকরো টুকরো করার বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে তথ্য দিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।

সৌদি ওই কর্মকর্তা বলেন, কনস্যুলেটের ভেতরে জামাল খাসোগিকে হত্যা করা হয় এবং হত্যার পর খাসোগির পোশাক পরে এক কর্মকর্তা কনস্যুলেট থেকে বের হয়ে যান। জামাল খাসোগি কনস্যুলেট থেকে বেরিয়ে গেছেন—এটা প্রমাণ করতেই এমন কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়।

সৌদি কর্মকর্তা বলেন, সৌদি আরবের গোয়েন্দা সংস্থার উপপ্রধান মেজর জেনারেল আহমেদ আল-আসিরি ১৫ জনের দল গঠন করেন। জামাল খাসোগির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে বুঝিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল সরকার। এ জন্য ১৫ সদস্যের এ দলকে ইস্তাম্বুলে পাঠানো হয়। তাঁকে ফিরিয়ে আনতে শান্তিপূর্ণ উপায় অবলম্বনের স্থায়ী আদেশ জারি ছিল ১৫ সদস্যের দলের প্রত্যেক সদস্যর প্রতি। তবে অনুমতি ছাড়া যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও ছিল ১৫ জনের। দলটির পরিকল্পনা ছিল, ইস্তাম্বুলের বাইরে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খাসোগিকে আটকে রাখার হবে। শেষ পর্যন্ত যদি রিয়াদে ফিরতে না চান, তবে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

সৌদি কর্মকর্তারা বলেন, ১৫ জনের দলে অনেক নির্দেশনা ছিল। কিন্তু শুরুতেই সবকিছু ভুল পথে পরিচালিত হতে থাকে। একপর্যায়ে কর্মকর্তারা আদেশ লঙ্ঘন করে দ্রুত সহিংস হয়ে ওঠেন। তারা খাসোগিকে কনসাল জেনারেলের কার্যালয়ে নেয়। যেখানে মাহের মুতরেব নামের এক কর্মকর্তার সঙ্গে তিনি তর্কে জড়িয়ে পড়েন।

খাসোগি মুতরেবকে বলেন, যদি তিনি এক ঘণ্টার মধ্যে কনস্যুলেট ভবন থেকে বের না হন, তাহলে তুরস্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন বাইরে থাকা তাঁর বান্ধবী।

মুতরেব কূটনৈতিক নীতি-নৈতিকতা লঙ্ঘন করছেন উল্লেখ করে খাসোগি বলেন, ‘আপনি আমার সঙ্গে কী করতে যাচ্ছেন। আপনি কি আমাকে অপহরণ করতে চান?’ মাহের মুতরেব বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা তোমাকে ওষুধ দেব এবং এখান থেকে তুলে নিয়ে যাব।’ এরপর খাসোগি চিৎকার শুরু করলে তাঁকে শান্ত করতে মুখে কাপড় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। চিৎকার থামানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে শ্বাসরোধে মারা যান খাসোগি।