সংসদে ধরাশায়ী থেরেসা মে'র সরকার

থেরেসা মে
থেরেসা মে

যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে বিতর্কের শুরুতেই সাংসদদের হাতে ধরাশায়ী হয়েছে দেশটির সরকার। গতকাল মঙ্গলবার বিতর্কের প্রথম দিনে ব্রেক্সিট চুক্তি বিষয়ক তিনটি ভোটাভুটির সব কটিতে হেরেছে থেরেসা মে’র সরকার। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী মে’র ব্রেক্সিট চুক্তির প্রতি সংসদের যে আস্থা নেই, সে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেল।

বিরোধী দল লেবার পার্টি সরকারকে ব্রেক্সিট চুক্তি বিষয়ক পূর্ণ আইনি পরামর্শ প্রকাশের দাবি জানিয়ে আসছিল। চাপের মুখে গত সোমবার অ্যাটর্নি জেনারেল জেওফরি কক্স পরামর্শের আংশিক সংসদে তুলে ধরেন। কিন্তু পূর্ণ পরামর্শ প্রকাশে সরকারকে বাধ্য করতে লেবার দল একটি মোশন (প্রস্তাব) আনে। এতে বলা হয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এমপিদের সামনে পূর্ণাঙ্গ তথ্য তুলে ধরতে সরকার বাধ্য। পূর্ণাঙ্গ আইনি পরামর্শ প্রকাশের দাবি প্রত্যাখ্যান সংসদের অবমাননা এবং সংসদীয় রীতির বরখেলাপ।

এই মোশন আটকাতে পাল্টা এক মোশনে সরকার বিষয়টি এমপিদের প্রিভিলেজ কমিটিতে সুরাহার প্রস্তাব করে।

শুরুতে সরকারের আনা মোশনটি সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপিদের ভোটে প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর দ্বিতীয় ভোটাভুটিতে লেবার দলের আনা মোশনটি গৃহীত হয়। ফলে পূর্ণাঙ্গ আইনি পরামর্শ প্রকাশে বাধ্য হলো সরকার। সেই সঙ্গে সরকার সংসদের অবমাননা (কনটেম্পট অব পার্লামেন্ট) করেছে বলে এমপিদের রায় এল। এই পরিস্থিতি যুক্তরাজ্যে নজিরবিহীন।

আগামী মঙ্গলবার (১১ ডিসেম্বর) ব্রেক্সিট চুক্তির ওপর এমপিদের ভোটাভুটি হবে। তাতে চুক্তি অনুমোদন না পেলে সরকারের করণীয় ঠিক করে দেবে সংসদ—সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ডমিনিক গ্রিভের আনা এমন প্রস্তাব নিয়েই অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় ভোটাভুটি। এতেও হেরে যায় সরকার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে প্রস্তাবটি পাশ হয়। এ প্রস্তাবের ফলে ব্রেক্সিট চুক্তির সংসদীয় গতিপথ বদলে গেল। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে সরকার নিজের ইচ্ছেমতো পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারবে না। বরং এমপিরা ঠিক করে দেবেন সরকারের করণীয়। ডমিনিক গ্রিভ ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের রাজনীতিক।

লক্ষণীয় ব্যাপার হলো কেবল বিরোধী দলগুলোর সাংসদরা নন; ভোটাভুটিতে সরকারি দলের অনেক সাংসদ সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা বলছেন, পরিস্থিতি থেকে স্পষ্ট সংসদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আর নেই। মে’র ব্রেক্সিট চুক্তি সংসদে পাশ হবে না বলেই তাঁদের পূর্বাভাস।

মঙ্গলবার বিতর্কের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী মে এমপিদের উদ্দেশে বলেন, তাঁর সম্পাদিত ব্রেক্সিট চুক্তি যুক্তরাজ্যের জন্য সর্বোত্তম বিকল্প। তিনি বলেন, ‘আমরা দাবি করছি না এই চুক্তি যথাযথ (পারফেক্ট)। এতে আপসের বিষয় রয়েছে। এটাই যে কোনো সমঝোতার ধর্ম।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই চুক্তি প্রত্যাখ্যানের ফল হবে চুক্তি ছাড়াই বিচ্ছেদ অথবা আদৌ কোনো বিচ্ছেদ না হওয়া।

প্রধানমন্ত্রীর এমন আহবান এমপিদের মন গলাতে পারেনি। একের পর এক এমপি বিতর্কে অংশ নিয়ে চুক্তির বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। লেবার দলের নেতা জেরেমি করবিন বলেন, এ চুক্তি জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ। তিনি আশা করেন মঙ্গলবার এমপিরা এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করবে। সে ক্ষেত্রে সরকারকে নতুন কোনো গ্রহণযোগ্য বিকল্প হাজির করতে হবে অথবা বিকল্প কিছু করার জন্য অন্যদের সুযোগ দিতে হবে। করবিনের এমন কথায় মধ্যবর্তী নির্বাচন দাবির ইঙ্গিত স্পষ্ট।

চুক্তির বিরোধিতা করে পদত্যাগ করা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, এই চুক্তিকে সমর্থন দেওয়া হবে বিচ্ছেদ চাওয়া ১৭ দশমিক ৪ মিলিয়ন ভোটারের সঙ্গে প্রতারণা।

মঙ্গলবারের বিতর্কে ব্রেক্সিট চুক্তির সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জবাব দেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী স্টিভ বার্কলে। কিছু আপস সত্ত্বেও চুক্তিটি দেশের জন্য মঙ্গলজনক দাবি করে রাত ১টায় তিনি প্রথম দিনের বিতর্কের ইতি টানেন। বুধবার দ্বিতীয় দিনের বিতর্কে চুক্তির নিরাপত্তা ও অভিবাসন বিষয়ক উপাদানগুলো নিয়ে আলোচনা হয়।

২০১৬ সালে এক গণভোটে যুক্তরাজ্যের মানুষ ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বিচ্ছেদের পক্ষে রায় দেয়। ব্রেক্সিট নামে পরিচিত এই বিচ্ছেদ ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ কার্যকর হওয়ার কথা। দীর্ঘ ১৮ মাস চেষ্টার পর উভয় পক্ষ বিচ্ছেদ বিষয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছায়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অনুমোদন পেলে তবেই কার্যকর হবে এই চুক্তি। বিরোধী দলগুলোর পাশাপাশি সরকারি দলের অনেক এমপি এই চুক্তির বিরোধিতা করছেন। বিচ্ছেদ বিরোধীদের পাশাপাশি চুক্তির বিষয়ে আপত্তি আছে বিচ্ছেদপন্থীদেরও। তাদের বিেরাধিতার কারণগুলো ভিন্ন ভিন্ন।