মোদির 'রথযাত্রার' সঙ্গে পাল্লা দিতে মমতার 'কীর্তন'

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কাল শুক্রবার থেকে বিজেপির ‘রথযাত্রা’ শুরু হচ্ছে। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিতে রাজ্যে ক্ষমতাসীনদের খোল ও করতাল নিয়ে কীর্তনের লড়াই জমে উঠেছে। কাল বুধবার কর্মীদের মধ্যে খোল ও করতাল বিতরণ করেছে তৃণমূল। 

রাজ্যে তৃতীয় এবং চতুর্থ দলও নামছে রাস্তায়। সেই দু্ই দল হলো কংগ্রেস এবং বাম দল। তবে রথ বা খোল করতাল নিয়ে নয়। নামছে লাল পতাকা আর তেরঙ্গা পতাকা নিয়ে। তারা রাজ্যজুড়ে সম্প্রীতির মিছিল করবে। ঝান্ডা নিয়ে রাস্তায় হাঁটবে, সভা সমাবেশ করবে।

আগামী বছরের এপ্রিল বা মে মাসে ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার ৫৪৩টি আসনের নির্বাচন হওয়ার কথা। এই পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে এই লোকসভার ৪২টি আসন। এই আসনের মধ্যে এখন ৩৪টি আসন দখল করে আছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। জাতীয় কংগ্রেসের দখলে আছে ৪টি, আর বাম দল ও বিজেপির দখলে আছে ২টি করে আসন। এবার মমতা দাবি করেছেন রাজ্যের ৪২টি লোকসভা আসনের সব ক’টিই ছিনিয়ে নেবে তৃণমূল। বিজেপি বলেছে, তারা এবার এই রাজ্যে জিততে চলেছে ২২টি আসনে। তবে বাম দল ও কংগ্রেস এখন পর্যন্ত ঘোষণা দেয়নি তারা ক’টি আসনে জিততে চলেছে। ফলে এই জয় নিয়ে রাজনৈতিক তরজা এখন তুঙ্গে রাজ্যজুড়ে।
আর রাজ্যজুড়ে নির্বাচনী ঝড় তোলার জন্য বিজেপি এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ’গণতন্ত্র বাঁচাও ’ নামে তিনটি প্রচার রথ বের করার। রথ তিনটি বের হবে রাজ্যর তিন প্রান্ত থেকে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কটাক্ষ করেছেন রথকে। বলেছেন, ’এত রথ নয়; যেন পাঁচতারা হোটেল।’ কী থাকবে না এখানে, এসি থেকে ইন্টারনেট সব ব্যবস্থা। থাকবে নেতাদের বিশ্রাম কক্ষ, খানাপিনার ব্যবস্থা। সেই রথযাত্রাই করবে এবার বিজেপি। এই রথ বের হবে কাল ৭, ৯ ও ১৪ ডিসেম্বর। কালকের রথ বের হবে কোচবিহার থেকে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগরদ্বীপ থেকে রথ বের হবে ৯ ডিসেম্বর আর বীরভূমের তারাপীঠ থেকে শুরু হবে ১৪ ডিসেম্বর।

এই রথযাত্রাকে ঘিরে তিনটি বড় সমাবেশ করবে বিজেপি। এই সমাবেশে উপস্থিত থাকার কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। সঙ্গে থাকবেন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা। থাকবেন বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও। এই রথযাত্রার মাঝেই প্রথম সমাবেশ হবে ১৬ ডিসেম্বর শিলিগুড়িতে। দ্বিতীয় সমাবেশ হবে ২৪ ডিসেম্বর বর্ধমানের দুর্গাপুরে। তৃতীয় সমাবেশ হবে ১১ জানুয়ারি নদীয়ার কৃষ্ণনগরে। এই তিনটি সমাবেশেই মোদির উপস্থিত থাকার কথা। আর চতুর্থ বা শেষ মহাসমাবেশ হওয়ার কথা ২৯ জানুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে। এই রথযাত্রার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। এই রথযাত্রায় বিভিন্ন সময় বিজেপি ২০০টি পথসভা করবে। ৩টি মহাসমাবেশ করবে। রথ তিনটি তৈরি হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে আধুনিক বাসের ওপর । শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই রথে থাকবে ইন্টারনেটের সুবিধাও। থাকবে বিশ্রামের জায়গা। রথ গুলি পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা কেন্দ্র ঘুরে শেষ হবে কলকাতায়। রথ বাঁচাতে প্রতিটি রথের সঙ্গে থাকবে বিজেপির ২০০ কর্মীর একটি মোটরসাইকেল বাহিনী। এরাই রথের সামনে পেছনে থাকবে তারা। পাহারা দেবে রথ।
এর আগে অবশ্য ১৯ জানুয়ারি মমতাও ডাক দিয়েছেন মোদি বিরোধী মহাসমাবেশের। সেই সমাবেশও হবে কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে। সেখানে উপস্থিত থাকবে বিজেপি বিরোধী সব রাজনৈতিক দল।

রথযাত্রার মতো ধর্ম আশ্রিত এক কর্মসূচির মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল ঘোষণা দিয়েছে তারা খোল-করতাল নিয়ে সংকীর্তন যাত্রা করবে। তারাপীঠে রথযাত্রার আগে বীরভূম জেলাজুড়ে বের হবে এই কর্মসূচি । পথে পথে তাঁদের কীর্তন দলের সদস্যরা গাইবেন গাইবেন ’হরে রাম হরে কৃষ্ণ’। তৃণমূল কংগ্রেসের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মন্ডল আগেই ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, এই সংকীর্তন যাত্রায় ভক্তদের হাতে তুলে দেওয়া হবে ৪ হাজার খোল আর ৮ হাজার করতাল। এগুলো বানিয়ে আনা হয়েছে নবদ্বীপ আর মুর্শিদাবাদ থেকে। এ জন্য খরচ হয়েছে প্রায় ২ কোটি রুপি। ভক্তরা এই খোল করতাল নিয়ে জেলার ১৯টি ব্লক জুড়ে সংকীর্তন করবেন। কাল বুধবার থেকে সেই খোল করতাল ভক্তদের মাঝে বিতরণ শুরু করেছেন অনুব্রত মন্ডল।
অনুব্রতর কথায়, বিজেপির ওই রথযাত্রা হবে ’শ্মশান যাত্রা’। দলের ’অন্তিম যাত্রা’। যদিও সিপিএমের বীরভূমের জেলা সভাপতি ও সাবেক সাংসদ রামচন্দ্র ডোম প্রশ্ন তুলে বলেছেন, কোথা থেকে এই টাকা পেল অনুব্রত মন্ডল— তা জানানো হোক জনগণকে। আবার স্থানীয় কংগ্রেস বিধায়ক মিলটন রশিদ বলেছেন, বিজেপির এ এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চক্রান্ত। এবার সাম্প্রদায়িকতার মুখোশ খসে পড়বে তৃণমূলেরও। আর বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন,’খোল করতালতো শবযাত্রায় লাগে। তৃণমূলের দিন শেষ। তাই শবযাত্রার জন্য খোল করতাল এনেছে। ’
তৃণমূল কংগ্রেসের পাশাপাশি এই রথযাত্রার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বাম দল এবং জাতীয় কংগ্রেস। তারা সমস্বরে বলেছে, এই রথযাত্রার বিরুদ্ধে তারা পথে নামবে।
আর এই রথযাত্রা নিয়ে বসে নেই তৃণমূল কংগ্রেস এবং বাম দল। তৃণমূল কংগ্রেস এবং বাম দল ঘোষণা দিয়েছে তারা রুখবে এই রথ।

এর আগে বিজেপির এই রথযাত্রা ঘোষণার পর সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র পাল্টা ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন , ’এই রাজ্যের মেহনতি ও শান্তিপ্রিয় মানুষ রাস্তায় নেমে বিজেপির রথযাত্রা আটকে দেবে। প্রয়োজনে রাস্তায় মানুষের দেয়াল তুলে দেবে , যাতে বিজেপির রাস্তা স্তব্ধ হয়ে যায়, রথযাত্রা যেন কোনো পথ খুঁজে না পায়’। এই মন্তব্যের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে বিজেপির মহিলা মোর্চার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি লকেট চট্টোপাধ্যায় পাল্টা হুমকি দিয়ে বলেছেন, ’বাংলায় রথযাত্রা আটকানোর চেষ্টা হলে , যাঁরা তা করবেন তাঁদের রথের চাকাতেই পিষে মারা হবে’। এরপরই হুগলির এক জনসভায় বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষও ফের হুমকি দিয়ে বলেছিলেন , ’এবার মারের বদলা হবে মার। আর হাসপাতালে কাউকে পাঠানো হবে না’।

এসব উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে । গত ২৬ নভেম্বর থেকে পশ্চিমবঙ্গের ৫০টি গণসংগঠন এই রথযাত্রার প্রতিবাদে রাজ্য জুড়ে শুরু করেছে ’সংহতি যাত্রা’। এই যাত্রা শেষ হবে আজ ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিন। এই দিনই বাম দল সহ বিভিন্ন দল গোটা রাজ্যজুড়ে পালন করছে সংহতি দিবস। আর রাজ্যের ৬টি বাম দল আজ বাবরি ধ্বংসের দিনে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সম্প্রীতি মিছিল বের করছে এই বাম দলগুলি।