সবুজ আর ধূসর জাপানি দুই শহরের গল্প

সাকুরার সেন্নারিতে বৌদ্ধ বেদিতে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন কাতসুয়া কোদামাস। ছবি: রয়টার্স
সাকুরার সেন্নারিতে বৌদ্ধ বেদিতে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন কাতসুয়া কোদামাস। ছবি: রয়টার্স

পাশাপাশি দুটো শহর সাকুরা ও ইনজাই। একটি যেন সবুজ প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। অন্যটি নিঃসঙ্গ মানুষের বিষাদে ধূসর। শুধু জনসংখ্যার কারণে জাপানের চিবা প্রশাসনিক অঞ্চলের দুটো শহর আজ ভিন্ন দুটি রূপে রয়েছে। দুই দশক পর এই ভিন্নতার মাত্রা আরও চরম আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ জন্য আঞ্চলিক সরকারগুলোকেই দায়ী করছেন বাসিন্দারা।

রয়টার্সের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই দুই শহরের আশা-নিরাশার গল্প।

সাকুরার একটি পার্কে নিঃসঙ্গ হেঁটে বেড়াচ্ছেন এক বৃদ্ধ। ছবি: রয়টার্স
সাকুরার একটি পার্কে নিঃসঙ্গ হেঁটে বেড়াচ্ছেন এক বৃদ্ধ। ছবি: রয়টার্স

জাপানের রাজধানী টোকিওর উপকণ্ঠের চিবা প্রশাসনিক অঞ্চলের শহর সাকুরার বাসিন্দা কাতসুয়া কোদামাসের স্ত্রী দুই বছর আগে মারা গেছেন। স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ বাড়ির বৌদ্ধ বেদিতে ৭৭ বছর বয়সী কাতসুয়া তাঁর ভস্ম রেখেছেন।
স্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে কাতসুয়া বলেন, ‘আমি রাত-দিন তাঁর সঙ্গে কথা বলতাম, তাঁকে সবকিছু বলতাম। অসুস্থ অবস্থায় তিনি যে চেয়ারে বসে গোসল করতেন, সেটাতে এখন বসে থাকি। চেয়ারটিতে বসলে অনুভূত হয়, আমি তাঁর কাছেই আছি।’
সাকুরার সেন্নারিতে ৩০ বছর আগে এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন এই দম্পতি। তাঁর মতো প্রিয়জন হারানোর এই অনুভূতি পুরো সাকুরায়। অথচ অতীতে জায়গাটি তরুণ বয়সী লোকজনে ভরা ছিল। এখন সেন্নারির বাসিন্দাদের প্রায় অর্ধেকের বয়স ৬৫ বছরের ওপরে। ১ লাখ ৭৫ হাজার বাসিন্দার সাকুরা শহরে এক বছরে ৪০০ মানুষ ঝরে গেছে।

এর চেয়ে পাশের ইনজাই শহর তুলনামূলক তারুণ্যে বেশি ভরপুর। সেখানে জীবনযাপন এর চেয়ে ভিন্ন। সেখানকার মোট ১ লাখ ৬০০ জনসংখ্যার মাত্র ২১ শতাংশের বয়স ৬৫ বছরের বেশি। এই হার পুরো সাকুরা থেকে ১২ শতাংশ কম এবং জাতীয় পর্যায়ের গড় হার থেকে ৭ শতাংশ কম। এটাকে নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ইনজাই শহরের একটি এলাকা। ছবি: রয়টার্স
ইনজাই শহরের একটি এলাকা। ছবি: রয়টার্স

সাকুরার মতো ইনজাই শহরও টোকিও থেকে কম দূরত্বে অবস্থিত। ট্রেনে প্রায় এক ঘণ্টার দূরত্বে। দুটো শহরেই মিশ্র উন্নয়ন এবং উন্মুক্ত জমি ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে। তবে শহর দুটির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখানে মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। জনসংখ্যা দুই দেশকে ভিন্ন পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

জাপান সরকারের মতে, ইনজাইয়ে ২০৪০ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যা বাড়তে থাকবে, অন্যদিকে সাকুরায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত জনসংখ্যা কমে যাবে। ওই সময়ের মধ্যে পুরো জাপানে জনসংখ্যার হার ১৬ শতাংশ কমে যাবে।
শহর দুটোর মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে—তরুণ পরিবারগুলোর কথা মাথায় রেখে ইনজাইয়ে পুনঃউন্নয়ন শুরু হয় আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। শহরের উদ্যমী মেয়র জাতীয় ও আঞ্চলিক সরকারের কাছে দেন–দরবার শুরু করেন চিবা নিউটাউন নামে সেখানে বড় আবাসন প্রকল্প নেওয়ার জন্য। এটা হওয়ার পর ইনজাইয়ের বাসিন্দাদের আকৃষ্ট করার জন্য নানা বিনোদনমূলক ব্যবস্থা নেয় ও পার্ক স্থাপন করা হয়। চাকরিজীবীদের জন্য কর ছাড় দেওয়া হয়।

ইনজাই শহরের একটি পার্কে মায়ের সঙ্গে খেলায় মত্ত এক শিশু। ছবি: রয়টার্স
ইনজাই শহরের একটি পার্কে মায়ের সঙ্গে খেলায় মত্ত এক শিশু। ছবি: রয়টার্স

সাকুরায় করা হয়েছে ঠিক উল্টোটি। জাপানের অন্যান্য শহরের মতো গতানুগতিকভাবে তা এগিয়েছে। নতুন প্রজন্মের কথা ভাবা হয়নি। বাসিন্দাদের ভাষ্য, এর সরকারব্যবস্থা ১৯৫৫ সাল থেকে একটি রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে। এই সরকার স্থানীয় ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে সহায়তা করছে, অথচ কোনো নতুন ব্যবসা চালু করছে না।

জাপানে বয়স্ক লোকের হার বাড়ছে, কমছে জনসংখ্যা। এই প্রেক্ষাপটে সাকুরা ও ইনজাই শহর দুটি দেখিয়ে দিচ্ছে, দেশের অন্যান্য শহরের টিকে থাকার ক্ষেত্রে কী করতে হবে। এখানে বয়স্ক নাগরিকদের যত্নআত্তির ক্রমবর্ধমান ব্যয় সামলানোর বিষয়টিও উঠে এসেছে। চিবা ইউনিভার্সিটির নগর-পরিকল্পনাবিষয়ক অধ্যাপক হিদেকি কোবায়াশি বলেন, ইনজাইয়ের মতো তরুণদের আকৃষ্ট করতে সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে, করছাড় ও দিবাযত্নকেন্দ্রের নিশ্চয়তা দিতে হবে।