'অ্যাবোরজিনালের' চেয়ে 'মাওরিরা'এগিয়ে?

ঐতিহ্যের সাজে মাওরি সম্প্রদায়। ছবি: রয়টার্স
ঐতিহ্যের সাজে মাওরি সম্প্রদায়। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বের অন্যতম পুরোনো দুটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী হলো ‘অ্যাবোরজিনাল’ ও ‘মাওরি’। প্রথম জনগোষ্ঠীর বাস অস্ট্রেলিয়ায়, অপরটির নিউজিল্যান্ডে। স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ডিসকভারির ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ অনুষ্ঠানে বিখ্যাত অভিযাত্রিক ও উপস্থাপক বিয়ার গ্রিলসের সঞ্চালনায় এই দুই জনগোষ্ঠীর জীবনাচারণ ও সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়েছে। সেই সুবাদে এই দুই সম্প্রদায় সম্পর্কে কারও কারও বেশ ভালো ধারণা আছে। অবশ্য এদের বিষয়ে ধারণাহীন মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে অ্যাবোরজিনাল সম্প্রদায়ের বসবাস। তবে সবচেয়ে বেশি বাস করে নিউ সাউথ ওয়েলস ও কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় তিন শতাংশ মানুষ অ্যাবোরজিনাল। এই সম্প্রদায় প্রায় ৬০ হাজার বছর থেকে থেকে দেশটিতে বসবাস করে আসছে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে তারা সেখানে অভিবাসী হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তাদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস প্রবল, মাটির সঙ্গে তাদের রয়েছে আত্মার বন্ধন। গত ছয় দশকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় তারা ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালীদের বৈষম্য, জুলুম, নির্যাতন, বাস্তুচ্যুত ও হত্যার শিকার হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট জানিয়েছে, ১৯৬২ সালে অ্যাবোরজিনালরা ভোটাধিকার পায়। গণভোটের প্রায় পাঁচ বছর পর তারা আদমশুমারিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে ১৯৯২ সালের আগ পর্যন্ত দেশটির উচ্চ আদালত তাদের ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি দেননি। সম্প্রতি অ্যাবোরজিনালদের উন্নয়নে উত্থাপিত নীতিগুলো নাকচ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে আইনে আছে, একই কাজের জন্য অস্ট্রেলিয়ার সাধারণ নাগরিকদের মতো অ্যাবোরজিনালের অবশ্যই সমান পারিশ্রমিক দিতে হবে।

স্থানীয় এই সম্প্রদায়ের সহযোগিতার জন্য প্রতি বছর মোটা অঙ্কের ডলার বিনিয়োগ করা হয়। প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না, বরং বৈষম্য ও ফারাক আরও বাড়ছে। নানা অপরাধের কারণে অস্ট্রেলিয়ার কারাগারগুলোর এক চতুর্থাংশ অ্যাবোরজিনাল দিয়ে ভরা। বিশ্বে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি এই সম্প্রদায়ের তরুণদের মধ্যে। তবে শিশুরা রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে পর্যাপ্ত সেবা-যত্ন পায়।

নিজেদের জীবিকা ও জীবনযাপন নিয়ে মূল ধারার অ্যাবোরজিনালদের মধ্যে হতাশা আছে। পরিস্থিতি উন্নয়নে সংবিধান সংশোধন করে আরও অধিকার নিশ্চিত করতে চায় তারা। আদিবাসী বা উপজাতি হিসেবে নয় ‘প্রথম জাতি’ হিসেবে তারা স্বীকৃতি চায়। কিন্তু রক্ষণশীল নেতৃত্বাধীন সরকার তাদের চাওয়া নাকচ করে দিয়েছে। ১৯৯৪ সালে পাস হওয়া আদিবাসী আইনের পর থেকে তাদের ভূমি অধিকার আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে। বন্য পশুপাখি ও মৎস্য শিকারের পাশাপাশি খনি সম্পদের মতো অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়ে দেশের ৩১ শতাংশের বেশি স্বত্ব আছে তাদের।

অস্ট্রেলিয়ার আরেক আদিবাসী গোষ্ঠী ইয়াউরু। এই গোষ্ঠীর মতো কিছু আদিবাসী গোষ্ঠী সরকারের সঙ্গে লাভজনক চুক্তি করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করেন ইয়াউরু অ্যাবোরজিনাল করপোরেশনের প্রধান পিটার ইউ। ব্রুম শহরে এখন সবচেয়ে বড় ভূমি মালিকানাধীন করপোরেশন তাদের। একটি গরুর খামার ও পশুসম্পদ রপ্তানির লাইসেন্স আছে তাদের। এসব থাকা সত্ত্বেও নিউজিল্যান্ডের মাওরিদের মতো সুবিধা করে উঠতে পারেনি তারা।

ঐতিহ্যের সাজে অ্যাবোরজিনাল সম্প্রদায়। ছবি: রয়টার্স
ঐতিহ্যের সাজে অ্যাবোরজিনাল সম্প্রদায়। ছবি: রয়টার্স

সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে ইউরোপ থেকে নিউজিল্যান্ডে আসে মাওরিরা। এতে তাদের জীবনাচরণে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। পাশ্চাত্যের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খেতে চলে তাদের জীবনসংগ্রাম। তবে বর্তমানে ক্ষমতায়ন ও সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব অংশগ্রহণ রয়েছে মাওরিদের। উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় অস্ট্রেলিয়া থেকে অনেক ‘অ্যাবোরজিনাল’ তাসমান সাগর পাড়ি দিয়ে নিউজিল্যান্ডে ঠাঁই নেয়। অ্যাবোরজিনালদের তুলনায় মাওরিদের গড় আয়ু বেশি। নিউজিল্যান্ডে ৫০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ১৫ শতাংশ মানুষ মাওরি। সাধারণত মাসের প্রথম সপ্তাহে তাদের আয় ৬১০ ডলার; যা একই কাজে নিয়োজিত অ্যাবোরজিনালদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। কারাবন্দী সংখ্যাও অ্যাবোরজিনালদের চেয়ে কম। মাওরিদের এটা তুলনামূলক সাফল্যের একটি চিত্র।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকেরা নিউজিল্যান্ডের আগে পৌঁছায়। ফলে সেখানে শাসন-শোষণের পাশাপাশি উন্নয়নও হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে আগে নিউজিল্যান্ডে বেশি সভ্য সমাজের উদ্ভব হয়। ১৮৪৩ সালে মাওরিদের সঙ্গে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের একটি চুক্তি সই হয়। এই চুক্তির আওতায় নিউজিল্যান্ড সরকার ও মাওরি সম্প্রদায়ের মধ্যে শক্তিশালী রাজনৈতিক সম্পর্কের কাঠামো তৈরি। যদিও সেই চুক্তি নিয়মিতভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে। তবে ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি ট্রাইব্যুনাল মাওরিদের কপাল খুলে দেয়। এর মাধ্যমে অবজ্ঞা ও অবহেলার জন্য তাঁরা আইনি প্রতিকার পেতে থাকে। এতে তারা তর তর করে এগিয়ে যেতে থাকে। সেই ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার যে কোনো আদিবাসী গোষ্ঠীর তুলনায় নিউজিল্যান্ডে মাওরিরা আরও বেশি সুসংগঠিত। উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত থাকতে তারা রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তারা একই ভাষায় কথা বলে। দেশটির পার্লামেন্টে মাওরিদের জন্য আসন সংরক্ষিত রয়েছে। বর্তমান ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন পিটারস মাওরি সম্প্রদায়ের। এ ছাড়া রয়েছেন তিনজন মাওরি ধর্মগুরু ও দুজন গভর্নর জেনারেল। গত ৩০ বছরে রাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের ৮৭টি চুক্তি সই হয়েছে। যা এখন পর্যন্ত মাওরিদের সহযোগিতা ও উন্নয়নে কাজ করছে। মাওরিদের নেতৃত্ব বেশ কিছু সফল কোম্পানি, কৃষি খামার, মৎস্য খামার, পর্যটন ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া টিডিবি নামে প্রভাবশালী আর্থিক ও অর্থনৈতিক পরামর্শ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান মাওরিদের অর্থনীতিকে অ্যাবোরজিনাল চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। গত জানুয়ারিতে অকল্যান্ডে আন্তর্জাতিক আদিবাসী ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার নারী আদিবাসী দলকে ৫-০ ব্যবধানে পরাজিত করেছে মাওরি নারী ফুটবল দল। সফলতা পেয়েছে মাওরি পুরুষ ফুটবল দলও। তারা ৩-২ ব্যবধানে পরাজিত করে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী দলকে। ক্রীড়াঙ্গনের এই সাফল্য মাওরিদের এগিয়ে যাওয়ার আরও একটি নিদর্শন বলে মনে করা হয়।

আদিবাসী নিয়ে এই দুই দেশের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ও জটিল। অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার নাগরিকেরা এখনো অ্যাবোরজিনালের আলাদা করে রেখেছে। অ্যাবোরজিনালদের প্রতি তাদের ধারণাও নেতিবাচক। অন্যদিকে নিউজিল্যান্ডের মূল ধারার নাগরিকেরা তাদের দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী তথা মিশ্র সংস্কৃতির জন্য গর্ব অনুভব করে। যা মাওরিদের এগিয়ে যাওয়ার পথকে অনেক সহজ করে দিয়েছে।