ইতালির 'পলান সরকার'

তিন চাকার এই গাড়িতেই অ্যান্তোনিও লা কাভার ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
তিন চাকার এই গাড়িতেই অ্যান্তোনিও লা কাভার ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

মনে আছে তো, একুশে পদকপ্রাপ্ত রাজশাহীর পলান সরকারের কথা? গ্রামে ঘুরে ঘুরে বেড়ান যিনি। ছোট–বড় সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন বই। প্রথম আলোয় প্রকাশিত আলোর সেই ফেরিওয়ালার গল্পে মুগ্ধ হয়েছিলেন দেশবাসী। দেশ পেরিয়ে সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পাড়ের দেশ ইতালিতেও দেখা মিলেছে এমনই এক ‘পলান সরকারের’।

নাম তাঁর অ্যান্তোনিও লা কাভা। বয়স প্রায় পলান সরকারেরই কাছাকাছি। মাথাভর্তি ধবধবে সাদা চুল। বিদেশি বলেই পাঞ্জাবি আর লুঙ্গির বদলে পরনে শার্ট আর প্যান্ট। পলান সরকার বই বিলি করতেন হেঁটে হেঁটে। আর অ্যান্তোনিও বিলি করেন তিন চাকার এক গাড়িতে।

বই পড়তে কে না ভালোবাসে? যে যা–ই বলুক না কেন, ইন্টারনেট আর ফেসবুকের যুগেও বই কিন্তু মরে যায়নি। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলায় তাই শত শত মানুষের ভিড় জমে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে তাই পড়ুয়ার অভাব হয় না। মফস্বলে এখনো ‘আলো আমার আলো গান’ বাজিয়ে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি এলে পড়ুয়াদের ভিড় জমে। স্কুলপড়ুয়া শিশুরা এখনো পড়ে রূপকথার রাজারানি আর রাক্ষসের গল্প। একটু বড় হতেই হাতে ওঠে তিন গোয়েন্দা। হিমু বা মিসির আলির দিকে হাত বাড়ানো হয় আরেকটু পরে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, সত্যজিৎ তো রয়েছেই। এরপর তো খুলে যায় কত জানালা। গল্প, উপন্যাস, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাসের কত কত বই। তবে রাজধানী বা বড় শহরে যতটা সহজে এসব বই হাতে আসে, গ্রামাঞ্চলে ব্যাপারটা তত সহজ নয়। সেখানে বইয়ের খিদে মেটানো কঠিন। এখনো নির্ভর করতে হয় পাড়ার লাইব্রেরির ওপর। অথবা ধার করে চলা বই পড়া। ছবিটা আমাদের দেশে যেমন, বাইরের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অনেকটা তেমনি।

বিবিসি অনলাইনের এক ভিডিওতে জানা যায় অ্যান্তোনিওর কথা। ইতালির দক্ষিণাঞ্চলে বনজঙ্গল আর পাহাড়ে ঘেরা বাসিলিকাতা এলাকা। সেখানকারই একটি স্কুলের শিক্ষক অ্যান্তোনিও। স্কুলে পড়ানোর সময় দেখেছেন, খুদে শিক্ষার্থীদের বই পড়ার ক্ষুধা। মনের খিদে আছে, অথচ মেটানোর খাবার নেই। তখন থেকেই কিছু করার কথা ভাবতে শুরু করেন অ্যান্তোনিও। পাঠাগার গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। কিন্তু পাহাড় আর জঙ্গল পেরিয়ে সেই পাঠাগারে আসবে কে?

গ্রামে গ্রামে ঘুরে বই বিতরণ করেন অ্যান্তোনিও লা কাভা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
গ্রামে গ্রামে ঘুরে বই বিতরণ করেন অ্যান্তোনিও লা কাভা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

তাই তিন চাকার গাড়িতে গড়ে তোলেন পাঠাগার। ২০ বছর ধরে তিনি সেই ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ইতালির পাহাড়ি পথে। পাঠাগারের নাম দিয়েছেন বিবলিয়োমোতোকারো। এটিই সম্ভবত ইতালির সবচেয়ে ছোট পাঠাগার।

স্কুলের শিশুরাই উৎসাহ জুগিয়েছিল অ্যান্তোনিওকে। অ্যান্তোনিওর ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার বিবলিয়োমোতোকারো আসামাত্রই ছুটে আসে শিশুরা। বেছে নেয় নিজের পছন্দের বই। রাস্তার ধারেই অনেকে বসে যায় পড়তে। দেখে মন ভরে যায় অ্যান্তোনিওর। অ্যান্তোনিও বাসিলিকাতার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর শিশুদের মধ্যে বই বিতরণ করেন। শুধু পড়া নয় নানা কর্মশালারও আয়োজন চলে। পড়ার পাশাপাশি লিখতে পারে পাঠকেরা। চাইলে শর্টফিল্মও বানাতে পারে।

শোনা যাক সাও পাওলোর দুই ভাইবোনের কথা। গ্রামটিতে প্রাথমিক স্কুলে পড়ে কেবল ওই দুই শিশুই। রোববার সাও পাওলোতে ছুটির দিন। সেদিন সব স্কুল বন্ধ। সেদিন অ্যান্তোনিও গাড়ি ছোটান সাও পাওলোর দিকে। কেবল খুদে ওই দুই ভাইবোনের জন্যই সেখানে যান তিনি। মনের মতো বই তুলে দেন দুই শিশুর হাতে।

অ্যান্তোনিও মনে করেন, তাঁর কাজের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য রয়েছে। তিন চাকার গাড়িতে ঘুরে তিনি সেসব মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে চান। এটিই তাঁর জীবনের আনন্দ।

অ্যান্তোনিও বিশ্বাস করেন, বিবলিয়োমোতোকারোর অস্তিত্ব থাকলে সাংস্কৃতিক চেতনার অস্তিত্ব থাকবে।

বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে বই বিলিয়ে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেন পলান সরকার। অ্যান্তোনিওকে দেখে তাঁর কথা মনে পড়বেই। দেশ-কালের সীমানা পার হয়ে দুজনে যেন একাত্ম। দুজনেই আলো ছড়ান। দুজনেই আলোকিত মানুষ। আলোকিত মানুষগুলোর এমন গল্প ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বজুড়ে।