সরকার সন্তান চায়, জনতা বিমুখ

রাষ্ট্রীয় স্লোগান এখন ‘দেশের জন্য সন্তান নাও’। ছবি: রয়টার্স
রাষ্ট্রীয় স্লোগান এখন ‘দেশের জন্য সন্তান নাও’। ছবি: রয়টার্স

বছর তিনেক আগে এক সন্তাননীতি থেকে সরে আসে চীন। জন্মহার কমছে—বিষয়টি এক দশক আগেও চীনের জন্য সুসংবাদ হিসেবে ধরা হতো। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই বিষয়ই কপালে চিন্তার ভাঁজ এনে দিচ্ছে নীতিনির্ধারকদের।

২০১৫ সালে যখন এক সন্তাননীতি বাতিল হলো, আশা করা হচ্ছিল দ্বিতীয় সন্তান নিতে আগ্রহী হবেন চীনা দম্পতিরা। তবে এখন সরকার চাইলেও দুই সন্তান নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন তাঁরা। যা এক কঠিন সংকটের দিকেই ইঙ্গিত করছে। রাষ্ট্রীয় স্লোগান এখন, ‘দেশের জন্য সন্তান নাও’।

সম্প্রতি বিবিসি অনলাইনে চীনের এই জনমিতি নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী লেখা প্রকাশিত হয়েছে। জন্মহার কমানো কীভাবে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তা তুলে ধরা হয়েছে। সমস্যা মোকাবিলায় চীনও পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। আগে যেখানে এক সন্তান নিলে নানা ধরনের সুবিধা দেওয়া হতো। এখন সেখানে দুই সন্তানের ক্ষেত্রে সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া নগদ প্রণোদনা বা কর মুক্তির মতো বিষয়গুলো যোগ করা হচ্ছে।

১৯৭৯ সালে চীনে বিতর্কিত এক সন্তাননীতি চালু করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল চীনে জন্মহার কমানো এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনা। ধারণা করা হয়, চীনের এক সন্তাননীতির কারণে দেশটিতে অন্তত ৪০ কোটি জন্মনিরোধ করা হয়। যেসব দম্পতি এই এক সন্তাননীতি লঙ্ঘন করেছেন, তাঁদের জন্য জরিমানা থেকে শুরু করে নানা শাস্তির বিধান ছিল। এমনকি জোর করে গর্ভপাত ঘটানোর মতো কঠোর সাজাও দেওয়া হতো।

বিগত দশকগুলোতে ক্রমাগত এই নীতি কিছুটা শিথিল করা হয়। কারণ বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন, এই নীতির কারণে চীনে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। বহু বছর ধরে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা পেয়েছে চীন। তবে হঠাৎ করেই যেন সব হারিয়ে যেতে বসেছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হলো—কোনো দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার, অর্থাৎ ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী জনসংখ্যার আধিক্য। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর দিক দিয়ে বিশ্বে পঞ্চমে ছিল চীন। ফলে শ্রমশক্তির দিক দিয়ে বেশ এগিয়ে ছিল দেশটি। কিন্তু চীনকে এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে জনসংখ্যা কমানোর চেয়ে জনসংখ্যা বাড়াতে হবে।

২০১৫ সালে যখন এক সন্তাননীতি বাতিল করা হলো—ধারণা করা হচ্ছিল স্বাধীনতা পেলে সন্তান নেওয়ার আগ্রহ বাড়বে জনগণের। তবে দেখা গেল, তরুণ সমাজের সন্তান নেওয়ার বিষয়ে তেমন আগ্রহ নেই। চীনের সরকারি পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ১ কোটি ৭৮ লাখ শিশুর জন্ম হয়েছে। ওই বছরে জনসংখ্যা বাড়ে ১৩ লাখ। প্রতি হাজারে প্রায় ১৩টি শিশু জন্ম নেয়; যা ২০০১ সালের চেয়ে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার।

২০১৭ সালে পুরোপুরি দুই সন্তাননীতি নেয় চীন। এ বছর জন্ম নেয় ১ কোটি ৭২ লাখ ৩০ হাজার শিশু; যা ২০১৬ সালের চেয়ে প্রায় ৬ লাখ ৩০ হাজার কম। এবার প্রতি হাজারে জন্ম নেয় ১২ দশমিক ৪৩ শিশু, যা ২০১৬ সালের চেয়ে শূন্য দশমিক ৫২ শতাংশ কম। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৮ সাল থেকে এই হার আরও কমতে পারে। আগামী ১০ বছরে ২৩ থেকে ৩০ বছর বয়সী চীনা নারীর সংখ্যা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমবে। এই ১০ বছরে গড়ে মাত্র ৮০ লাখ শিশুর জন্ম হতে পারে।
এমন অবস্থায় সরকারি পর্যায়ে প্রচার চালানো হচ্ছে যে ‘সন্তান নেওয়া এখন কেবল পরিবারের বিষয়, নয় জাতীয় বিষয়।’ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, কম জন্মহারের প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য রাষ্ট্রের নতুন নীতি নেওয়ার প্রয়োজন আছে।

এদিকে জন্মহার কমলেও গড় জীবন প্রত্যাশা বেড়েছে মানুষের। যখন এক সন্তাননীতি চালু ছিল, তখন গড় জীবন প্রত্যাশা ছিল ৬৬ বছর। এখন এই বাধ্যবাধকতা না থাকায় জীবন প্রত্যাশা ৭৬ বছর; যা সামনের দশকগুলোতে চীনের অর্থনীতিতে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করবে।

সরকারি তথ্যমতে, ২০১৩ সালে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী জনসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি। তবে এরপর থেকে এই সংখ্যা কমতে থাকে, যা এখনো কমেই চলেছে। অন্যদিকে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৭ সালে চীনের মোট জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১৩৯ কোটিতে। যার মধ্যে ৬৫ বছরের ওপরে জনসংখ্যা রয়েছে ১৫ কোটি ৮০ লাখ; যা মোট জনসংখ্যার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ মানুষ ৬৫ বছরের ওপরে হলে সেই দেশকে বয়স্ক সমাজ বলে সংজ্ঞায়িত করা যায়। সংস্থাটি আশঙ্কা করছে, ২০৩০ সাল নাগাদ চীনের ১৭ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে হবে।

চীনা গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে একজন বয়স্ক মানুষের বিপরীতে যেখানে ৩ দশমিক ১৬ জন তরুণ ছিল, ২০১৬ সালে এসে তা দাঁড়ায় ২ দশমিক ৮ জনে। ২০৫০ সাল নাগাদ তা ১ দশমিক ৩ জন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সন্তান না নেওয়ার কারণ

আসলে তিন দশক ধরে কঠোর পরিবার পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে গেছে চীন। পরিবারের এক সন্তানেরা বেড়ে উঠেছেন বেশ সচ্ছলতার মধ্য দিয়ে। একই সঙ্গে একমাত্র সন্তান হওয়ায় কোনো ধরনের ভাগাভাগিতে যেতে হয়নি তাঁদের। অনেক স্বাধীনতা উপভোগ করেছেন তাঁরা। দেখা গেছে, এই সন্তানেরাই বড় হয়ে বেশ দেরি করে বিয়ে করছেন। সন্তানও নিচ্ছেন দেরিতে। তাঁরা নিজেদের পেশা ও ক্যারিয়ার গড়ার দিকেই মনোযোগ দিচ্ছেন বেশি। নিজেদের খুশিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।

বছর তিনেক আগে এক সন্তাননীতি থেকে সরে আসে চীন। ছবি: রয়টার্স
বছর তিনেক আগে এক সন্তাননীতি থেকে সরে আসে চীন। ছবি: রয়টার্স

এখনকার চীনের অনেক তরুণই মনে করেন না—সন্তান তাঁদের প্রথম প্রাধান্য। যখন তাঁরা একটি পরিবার শুরু করার কথা চিন্তা করেন, তখন তাঁরা এই দায়িত্ব বহন করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন থাকেন। জরিপে দেখা গেছে, একটি সন্তান লালন–পালনে একটি পরিবারের মোট আয়ের অর্ধেক ব্যয় হয়। বেশির ভাগ সময় শিশু যত্নকেন্দ্রগুলোতে স্থান সংকুলান হয় না। অনেকেই বৃদ্ধ বাবা–মায়ের কাছে সন্তান লালন–পালনের ভার দেন। এ জন্য তাঁদের ভরণপোষণ ও বাড়ির ঋণের ভারও নিতে হয় তাঁদের।

আসলে এক সন্তান লালন–পালনই অনেক খরচার ব্যাপার, সেখানে আরও একটির জন্য অনেক বেশি সহযোগিতা ও অর্থের প্রয়োজন। এটিই চীনাদের দ্বিতীয় বা আরও সন্তান নেওয়ায় বিমুখ করেছে। অনেকে বলেন, তাঁদের সময়ে পরিবারের অনেকের ভার তাঁদেরই নিতে হয়েছে। বৃদ্ধ বাবা–মা, সন্তান, চাকরি। একসময় ভেঙে পড়ে ধৈর্য।

এমন অবস্থায় চীনা নাগরিকদের আরও বেশি সন্তান নিতে আগ্রহী করে তুলতে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন প্রণোদনা ঘোষণা করার। মোট দেশজ উৎপাদনের ২ থেকে ৫ শতাংশ এই কাজে ব্যয়ের পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা। মূলত কর কমানো ও নগদ প্রণোদনার বিষয়টি তাঁদের মূল পরিকল্পনা। অনেকে বলছেন, এমন নিয়ম করা উচিত, জনগণ তাদের মনমতোই সন্তান নেবে। বিভিন্ন স্লোগান দেওয়া হচ্ছে—যেমন ‘এক সন্তান বানাবে গরিব, দুই সন্তান করবে ধনী’। তবে অনেকে মনে করছেন, বেশি তাড়াহুড়া করছে সরকার। নতুন নিয়মে অভ্যস্ত হতে জনগণের আরেকটু সময় লাগবে।

চীনের এই সমস্যার সঙ্গে জাপানের সমস্যার কিছুটা মিল রযেছে। বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী নিয়ে অর্থনৈতিক চাপ অনুভব করছে জাপানও। তবে দুটি দেশের মধ্যে পার্থক্য হলো চীন সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে এই পরিস্থিতির তৈরি করেছে; যা জাপান করেনি। সম্প্রতি আর্ন্তজাতিক মুদ্রা সংস্থা (আইএমএফ) জানায়, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের অর্থনীতি এখন ২৫ দশিমক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের। ২০১৭ সাল থেকে দেশটির অর্থনীতি ৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রে অর্থনীতি বিবেচনা করার সময় জনসংখ্যা ও জনতাত্ত্বিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো খেয়াল রাখার পরামর্শ দেয় আইএমএফ। আইএমএফ মনে করে, ভালো সময় বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিন্তু সুষম নীতিমালা টিকে থাকে। তাই জনসংখ্যার সমস্যা মোকাবিলায় চীন এখন কী পদক্ষেপ নেয়, তা–ই এখন দেখার বিষয়।