মনে পড়ে বুথাইনার চোখ দুটো?

উদ্ধারের পর আহত বুথাইনার কালশিটে পড়া বন্ধ চোখ ও এক হাত দিয়ে এক চোখ খোলার ছবি নাড়া দেয় বিশ্ব মানবতাকে। ছবি: এএফপি
উদ্ধারের পর আহত বুথাইনার কালশিটে পড়া বন্ধ চোখ ও এক হাত দিয়ে এক চোখ খোলার ছবি নাড়া দেয় বিশ্ব মানবতাকে। ছবি: এএফপি

বেশ বড় একটা পরিবার ছিল বুথাইনার। মা-বাবা, চার বোন, এক ভাই আর চাচাদের নিয়ে সুখের এক সংসার। প্রায়ই সন্তানদের বুকের কাছে নিয়ে গান গেয়ে শোনাতেন বুথাইনার বাবা। মায়ের ভালোবাসা মাখা ছিল পুরো পরিবারে। ভাইবোনদের সঙ্গে খেলা করতে খুব ভালোবাসত বুথাইনা। তবে হঠাৎ করেই যেন সব ওলট-পালট হয়ে গেল। তছনছ হয়ে গেল সবকিছু।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। দিনটি কোনো দিনও ভুলবে না আট বছরের ছোট্ট বুথাইনা মনসুর আল রিমি। ইয়েমেনের সানাতে তাদের নিজেদের বাড়িতে মায়ের ঘরে বসে পরিবারের সবাই মিলে গল্প করছিল সেদিন। হঠাৎ বাড়ির কাছেই বোমা পড়ে। ভয় পেয়ে যায় সবাই। তবে পরিবারের কর্তা বুথাইনার বাবা মাথা ঠান্ডা রেখে সবাইকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওই দিনটি তাদের জীবনের শেষ দিন হিসেবে লেখা হয়ে গিয়েছিল। আবার হামলা। বিমান থেকে ফেলা পরপর তিনটি বোমায় ধসে পড়ে বুথাইনাদের বাড়ি। নিহত হয় বুথাইনার মা-বাবা, চার বোন, এক ভাই আর সবচেয়ে প্রিয় চাচা।

উদ্ধারের পর আহত বুথাইনার কালশিটে পড়া বন্ধ চোখ ও এক হাত দিয়ে এক চোখ খোলার ছবি নাড়া দেয় বিশ্ব মানবতাকে। সব হারানো ছোট্ট মেয়েটির মুখের যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি যেন বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে দেয়। বিশ্বকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ইয়েমেনের বর্তমান অবস্থা।

এখনো পুতুল নিয়ে খেলে বুথাইনা। ছবি: এএফপি
এখনো পুতুল নিয়ে খেলে বুথাইনা। ছবি: এএফপি

২০১৫ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন একটি আরব সামরিক জোট ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে। তারপর থেকে তারা ইয়েমেনের ইরানঘেঁষা বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুতিদের লক্ষ্য করে একের পর এক বিমান হামলা চালাতে শুরু করে। এসব হামলায় বেসামরিক লোকজনের প্রাণহানিই হয় বেশি। তবে এসব হামলা ইচ্ছাকৃতভাবে করা নয় বলে দাবি করে আসছে সৌদি সামরিক জোট।

ওই দিনের হামলায় বুথাইনার পরিবারের সদস্যেরা ছাড়াও দুই শিশুসহ আরও আটজন নিহত হন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, যেসব বোমা নিক্ষেপ করা হয়, তা যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ছিল। এ ঘটনার দায় স্বীকার করে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট। এই প্রাণহানি কেবল ‘প্রযুক্তিগত ভুল’ হিসেবে বর্ণনা করে তারা। অথচ জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এই ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ আগেই সৌদি বিমান হামলায় ৪২ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে ইয়েমেনে।

তবে বুথাইনার বন্ধ ছোট্ট চোখ হাত দিয়ে খোলার চেষ্টা যেন সারা বিশ্বের মানুষের চোখ খুলে দেয়। সেই ছবি মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ে। তীব্র নিন্দার ঝড় ওঠে। এই ঘটনার এক মাস পর বুথাইনাকে চিকিৎসার জন্য সৌদি আরবে নিয়ে আসা হয়। তবে কোন প্রেক্ষাপটে সানা থেকে তাকে রিয়াদে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা পরিষ্কার নয়। হুতি বিদ্রোহীরা দাবি করে, বুথাইনাকে এক চাচাসহ অপহরণ করেছে জোট।

অন্যদিকে, সৌদি গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইয়েমেনি সরকারের অনুরোধে বুথাইনাকে রিয়াদে নেওয়া হয়েছে। পরে ১৯ ডিসেম্বর সৌদি গণমাধ্যমে রিয়াদ বিমানবন্দর থেকে বুথাইনার ছবি প্রকাশ করা হয়। তাকে চিকিৎসা শেষে সানাতে পাঠানো হয়। হুতি–সমর্থিত গণমাধ্যমগুলো এ ঘটনার শিরোনামে লেখে: ‘সৌদি আরবের কবজায়’ও ‘মানবতার চোখ শত্রুদের প্রকাশ করে দেয়’।

চাচা ও চাচাতো বোনের সঙ্গে বুথাইনা। ছবি: এএফপি
চাচা ও চাচাতো বোনের সঙ্গে বুথাইনা। ছবি: এএফপি

এখন বেশ সুস্থ বুথাইনা। চাচার সঙ্গে থাকছে সে। চাচাতো ভাইবোনের সঙ্গে খেলা করে সময় কাটে তার। প্রথমবারের মতো স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে সে। অনাথ শিশুটি যেন চাচার চোখের মণি। ভাইয়ের এই সন্তানকে নিজের করেই মানুষ করার সংকল্প নিয়েছেন চাচা আলী।

হুতি উচ্চপর্যায়ের কাউন্সিলের প্রধান মাহদি আল মাশতের আদেশে আলীকে একটি চাকরি দেওয়া হয়েছে। আর্থিক কষ্ট কমেছে তাঁদের।

তবে প্রায়ই ডুকরে কেঁদে ওঠে বুথাইনা। বাবা, মা, ভাই, বোনদের স্মৃতি এতটুকু মোছেনি তার মন থেকে। জীবনের এই ঘাত–প্রতিঘাত যেন ছোট্ট মেয়েটিকে বয়সের তুলনায় বড় করে ফেলেছে। গম্ভীর হয়ে সে বলে, ‘আমি চাই এই যুদ্ধ বন্ধ হোক। আমরা শান্তিতে বাঁচতে চাই। ইয়েমেনের শিশুরা শান্তিতে বাঁচতে চায়।’

হুতি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রেসিডেন্ট আব্দ-রাব্বু মনসুর হাদিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাজধানী সানা দখল করে নেওয়ার পর এই গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে সৌদি জোট। এরপর থেকে এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত ২ হাজার ২০০ শিশুসহ ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যুদ্ধের কারণে আরব উপদ্বীপের সবচেয়ে দরিদ্র এ দেশ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছে।