যুক্তরাষ্ট্র অকূলে ভাসাল কুর্দিদের!

২০১৬ সালের আগস্টে সিরিয়ার কামিশলি শহরে কুর্দি নারী যোদ্ধা ১৮ বছরের আসিয়া রামাজান আন্তার আইএসের হামলায় নিহত হন। ছবি: টুইটার
২০১৬ সালের আগস্টে সিরিয়ার কামিশলি শহরে কুর্দি নারী যোদ্ধা ১৮ বছরের আসিয়া রামাজান আন্তার আইএসের হামলায় নিহত হন। ছবি: টুইটার

সিরিয়ার কোবানি এলাকার একটি কবরস্থান। মাহমুদ রাসুলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন শোকার্ত কয়েকজন। মা নাজমা কবরের পাশে আহাজারি করছিলেন। চুমু খাচ্ছিলেন কবরের শিয়রে সাঁটানো ছেলের ছবিতে। বিলাপ করে তিনি বলে যাচ্ছিলেন, ‘ওঠো বাবা, ওঠো।’ পরিবারের অন্য সদস্যরা মা নাজমাকে মাটি থেকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

কোবানির এই কবরস্থান এমন প্রিয়জন হারানো মানুষের আহাজারিতে ভারী হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের সঙ্গে লড়াইয়ে নিহত মানুষের সমাধি এখানে। নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ করতে প্রতি শুক্রবার স্বজনেরা আসেন কবরস্থানটিতে।

২৭ বছর বয়সী মাহমুদ রাসুল কিছুদিন আগে দের ইজর শহরের কাছে আইএসের হামলায় নিহত হন।

সিএনএনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের কোবানি শহরে আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আট হাজার সিরীয় কুর্দি নিহত হয়েছেন। আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী ও অপরিবর্তিত মিত্র এই কুর্দিরা। আইএস পরাজয়ের প্রায় দ্বারপ্রান্তে। তবে পূর্ব দিকে ইরাক সীমান্তে এখনো এই যুদ্ধ চলছে। তবে খুব শিগগির এই কুর্দিদের একাই এই লড়াই চালাতে হবে। কারণ, সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে দুই হাজারের বেশি মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণায় ত্যক্তবিরক্ত নাজমা। কুর্দিদের ভবিষ্যতের ওপর এর প্রভাব পড়বে বলেও তিনি চিন্তিত। তিনি বলেন, ‘তারা (যুক্তরাষ্ট্র) যা চেয়েছিল, পেয়ে গেছে। আইএস থেকে বাঁচতে তারা কুর্দিদের ব্যবহার করেছে। এখন তারা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমেরিকা আমাদের সহায় হিসেবে ছিল। এখন তারা এরদোয়ানের হাতে আমাদের ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। তারা আমাদের জন্য একসময় ত্যাগ স্বীকার করলেও এখন চলে যাচ্ছে।’

কুর্দিদের শত্রু বলে মনে করে তুরস্ক। কুর্দিদের ব্যাপারে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান কট্টর মনোভাব পোষণ করেন। তাই যুক্তরাষ্ট্র চলে গেলে কুর্দিদের ‘দেখে নেওয়ার’ সুযোগ তুরস্ক হাতছাড়া করবে না বলে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সিরিয়ার রাকা শহরে কুর্দি নারী-পুরুষ যোদ্ধারা। ছবি: রয়টার্স
সিরিয়ার রাকা শহরে কুর্দি নারী-পুরুষ যোদ্ধারা। ছবি: রয়টার্স

সিরিয়ায় আইএস পরাজিত হয়েছে—এমন যুক্তিতে গত বছরের ডিসেম্বরে সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। তাঁর এ ঘোষণার বিরোধিতা করে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর পেন্টাগনের তিন শীর্ষ ব্যক্তি পদত্যাগ করেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিসের পদত্যাগের পর তাঁকে অনুসরণ করে পদত্যাগ করেন আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যৌথ বাহিনীতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত ব্রেট ম্যাকগার্ক এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের চিফ অব স্টাফ কেভিন সুয়েনি।

সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পরপর কুর্দি বাহিনীর সুরক্ষার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তুরস্কের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এ নিয়ে সমঝোতার একটি চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে তুরস্ক এতে সাড়া দিচ্ছে না। উল্টো তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান যুক্তরাষ্ট্রের এমন আহ্বানের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

গত রোববার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টুইটারে বলেন, কুর্দিদের আঘাত করলে তুরস্কের অর্থনীতিতে ধস নামিয়ে দেওয়া হবে। তবে তাঁর এ হুমকি তুরস্ক কতটা আমলে নিয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট হয়নি।

মার্কিন বাহিনী কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়া ডেমোক্রেটিক ফোর্সের (এসডিএফ) সঙ্গে কাজ করছে। এসডিএফে মূল লড়াকু বাহিনী হচ্ছে পিপলস প্রোটেকশন ইউনিটস (ওয়াইপিজি) মিলিশিয়া। এই ওয়াইপিজিকে তুরস্ক সন্ত্রাসবাদী বলে থাকে। তুরস্কের দাবি, ওয়াইপিজি নিষিদ্ধ কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) সম্প্রসারিত সংগঠন। পিকেকে তুরস্কে কুর্দি স্বায়ত্তশাসন চেয়ে তিন দশক ধরে লড়াই করেছে। তবে ওয়াইপিজি পিকেকের সঙ্গে কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেছে।

এ পরিস্থিতিতে কুর্দিরা এখন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। সিরিয়ার একদম সীমান্তে তুরস্ক, যে দেশটি তাদের জঙ্গি ভাবে। পশ্চিমে বাশার আল-আসাদ নিয়ন্ত্রিত সিরিয়া। প্রেসিডেন্ট বাসারের রয়েছে রাশিয়া ও ইরানের সমর্থন। প্রেসিডেন্ট বাসার বরাবরই বলে আসছেন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা কুর্দি–নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলসহ সিরিয়ার প্রতিটি ইঞ্চি তিনি নিয়ন্ত্রণে নেবেন।

সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে দুই হাজারের বেশি মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। ছবি: এএফপি
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে দুই হাজারের বেশি মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। ছবি: এএফপি

আরিমাহ শহরে কুর্দি সামরিক কমান্ডার ও মুখপাত্র শারফান দারউইশের সঙ্গে কথা বলে সিএনএন। তিনি বলেন, কুর্দিদের যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ, সেটা আমেরিকা দিয়েছে। বিনিময়ে কুর্দিরা আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। তিনি বলেন, ‘এই কয় বছর আমরা একসঙ্গে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) ন্যূনতম দায়িত্ব ছিল আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সারা জীবন ধরে থাকবে—এমন প্রত্যাশা কেউ করে না। তবে এ সময়টাকে বেছে নেওয়া (সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা) অদ্ভুত লেগেছে। যেভাবে ঘোষণাটি এসেছে, তাও অদ্ভুত লেগেছে।’

মার্কিন সেনারা চলে গেলে নিজেদের নিরাপত্তায় বিকল্প হিসেবে কুর্দিরা বাশার সরকারের শরণাপন্ন হতে পারে। রাশিয়ার মাধ্যমে বাসার সরকারের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

আমিরাহ শহরে কিছুটা এগোলে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা উড়তে দেখা যায়। তবে এ পতাকা আর বেশি দিন সেখানে উড়বে না। মার্কিন সেনাদের কিছু কিছু স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। কুর্দিদের ভাগ্যে কী আছে, তা কেউ জানে না। সিএনএন প্রতিবেদক যখন সেখানে উপস্থিত হন, তখন দুই কুর্দি সেনার মরদেহ দাফনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছিল। কফিনের পাশে কিছু মানুষ নীরবে কাঁদছিলেন। সড়কের পাশে বোমা হামলায় ওই দুই সেনা নিহত হয়েছেন। এমনভাবে প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে হয় কুর্দিদের।

ফিরে যাওয়া যাক কোবানি সমাধিস্থলে। ১৯ বছরের কুর্দি তরুণী যোদ্ধার কবরের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর মা আদেল কাসিম। কুর্দির ওয়াইপিজি মিলিশিয়ার হয়ে লড়তেন তাঁর মেয়ে পেমান তোলহিলদান। আইএসের হামলায় তিনি নিহত হন। মেয়েকে নিয়ে অনেক গর্ব মা আদেল কাসিমের। তিনি বলেন, ‘ও (পেমান) এত সাহসী ছিল। ওর ইউনিটে ও ছিল কমান্ডার। সে আইএসের বিরুদ্ধে ১৩ ঘণ্টা লড়াই করেছিল। লড়াইয়ের একপর্যায়ের ওদের গোলাবারুদ শেষ হয় গেলে ওরা আইএসের কাছে ধরা না দিয়ে নিজেদের উড়িয়ে দেয়।’ তিনি জানান, পেমানের হাড়গোড় আর বুট ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি।

মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। এরপর বলেন, ‘এটা ভুল হচ্ছে, ভুল হচ্ছে। তারা (যুক্তরাষ্ট্র) আমাদের মাঝপথে রেখে চলে যাচ্ছে।’