চীন ছুঁলে কত ঘা?

চীনের আদালতে কানাডার নাগরিক রবার্ট লয়েড শেলেনবার্গ। দালিয়েন, লিয়াওনিং, চীন, ১৪ জানুয়ারি। ছবি: এএফপি
চীনের আদালতে কানাডার নাগরিক রবার্ট লয়েড শেলেনবার্গ। দালিয়েন, লিয়াওনিং, চীন, ১৪ জানুয়ারি। ছবি: এএফপি

কথায় আছে, ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা’। তো চীন ছুঁলে কত ঘা?

এই প্রশ্নের উত্তর নগদের ওপর টের পাচ্ছে কানাডা।

যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে গত বছরের ১ ডিসেম্বর চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মেং ওয়ানঝুকে গ্রেপ্তার করে কানাডা। এ নিয়ে চীনের সঙ্গে কানাডার টক্কর বাধে।

এক ওয়ানঝুকে গ্রেপ্তার করে চীনকে চটিয়ে কানাডা এখন চড়া মূল্য গুনছে।

হংকং থেকে মেক্সিকো যাওয়ার পথে ভাঙ্কুভার বিমানবন্দরে ওয়ানঝুর যাত্রাবিরতি ছিল। এ সময়ই তাঁকে গ্রেপ্তার করে কানাডার কর্তৃপক্ষ। এই উঁচু দরের ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার কারণ তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। পরে খবর বের হয়, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করার অভিযোগে ওয়ানঝু গ্রেপ্তার হয়েছেন। বিচারের জন্য তাঁকে চায় যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর ৩০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

ওয়ানঝু গ্রেপ্তার হওয়ার খবর পেয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাতে সময় নেয়নি চীন। প্রতিক্রিয়াটা বেশ কড়াই ছিল। ওয়ানঝুকে দ্রুত ছেড়ে না দেওয়ার পরিণতি মারাত্মক হবে বলে হুমকি দিয়ে রাখে চীন। তখনই আঁচ করা গিয়েছিল, জল অনেক দূর গড়াবে।

চীন ধপাধপ কানাডার বেশ কয়েকজন নাগরিককে ধরে ফেলে। এই সংখ্যা ১৩ বলে দাবি করে কানাডা। পরে অবশ্য তাঁদের অধিকাংশই ছাড়া পান। তবে দুজন এখনো চীনের বন্দিশালায় আছেন। তাঁরা হলেন সাবেক কূটনীতিক মাইকেল কভরিগ ও ব্যবসায়ী মাইকেল স্প্যাভর। জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন করার সন্দেহে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে চীনের ভাষ্য।

চীন-কানাডা সম্পর্কের এই টানাপোড়েনের মধ্যেই গত সোমবার অটোয়ার জন্য বড় দুঃসংবাদ আসে। এদিনই কানাডার নাগরিক রবার্ট লয়েড শেলেনবার্গকে (৩৬) মাদক চোরাচালানের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন চীনের লিয়াওনিং প্রদেশের দালিয়েন ইন্টারমিডিয়েট পিপলস কোর্ট।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে গ্রেপ্তার হন শেলেনবার্গ। ২০১৬ সালের মার্চে তাঁর বিচার শুরু হয়। গত বছরের নভেম্বরে তাঁর ১৫ বছরের কারাদণ্ড হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন তিনি। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষভাগে উচ্চ আদালত পুনর্বিচারের আদেশ দেন। মাত্র এক দিনেই শুনানি নিয়ে পুনর্বিচারের রায় ঘোষণা করা হয়। আগে দেওয়া হয়েছিল ১৫ বছরের কারাদণ্ড—এবার মৃত্যুদণ্ড।

রায়ের ব্যাপারে খুবই শক্ত ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। এই রায়কে রাজনৈতিক মনে করেন তিনি। রায়কে চরম উদ্বেগজনক হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেছেন, চীন অযৌক্তিকভাবে মৃত্যুদণ্ডের অপব্যবহার করছে। এ ব্যাপারে কানাডার বন্ধুদেশগুলোরও ভীষণ উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।

চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মেং ওয়ানঝু। ছবি: ছবি: এএফপি
চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মেং ওয়ানঝু। ছবি: ছবি: এএফপি

শেলেনবার্গের মৃত্যুদণ্ডাদেশের পর চীন ভ্রমণের ক্ষেত্রে নাগরিকদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতেও বলেছে কানাডা।

ছেড়ে কথা বলেনি বেইজিং। ট্রুডোর অভিযোগ নাকচ করে তাঁকে দায়িত্বহীন মন্তব্য বন্ধ করতে সতর্ক করেছে চীন। কানাডা ভ্রমণের ব্যাপারে চীনও তার নাগরিকদের সতর্ক করেছে।

ওয়ানঝুর ব্যাপারে অটোয়ার ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করতে বেইজিং শেলেনবার্গের মামলাটিকে ব্যবহার করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির সিটন হল ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক ম্যাগি লুইস চীনা আইন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তাঁর ভাষ্য, কোনো মামলার বিচারের গতি বাড়িয়ে দেওয়া বা থামিয়ে দেওয়ার কাজটি চীনা কর্তৃপক্ষ চাইলেই করতে পারে।

জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক ডোনাল্ড ক্লার্কের পর্যবেক্ষণ, পুনর্বিচারে বড় সাজা বিরল। কিন্তু এখানে (শেলেনবার্গের মামলা) সেটাই হয়েছে। এই মামলার বিচার দেখে মনে হচ্ছে, মানুষকে জিম্মি করার কূটনীতি নিয়েছে চীন।

ওয়ানঝু গ্রেপ্তার হওয়ার জেরে চীন যে পাল্টা পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা কানাডায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লু শে অনেকটা স্বীকার করেছেন। মতামতধর্মী এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, চীন আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে।

চীনের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দেশে ট্রুডোর ওপর চাপ বাড়ছে। তবে শেলেনবার্গের মৃত্যুদণ্ডাদেশের পর কানাডা বেকায়দায় পড়েছে। মৃত্যুদণ্ডাদেশের বদলে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়ার উপায় নেই অটোয়ার। কারণ, কানাডায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। এখন কানাডা কী করবে?

উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে অটোয়ার জন্য একটা সহজ উপায়—ওয়ানঝুকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ না করে তাঁকে কানাডা ত্যাগ করতে দেওয়া। কিন্তু এখানেও জটিলতা আছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানাডার থাকা প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী ওয়ানঝুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র যদি তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহার না করে, তাহলে তাঁকে মাসের পর মাস কিংবা বছরের পর বছর কানাডীয় হেফাজতে থাকতে হতে পারে।

আরও পড়ুন: