ব্রেক্সিট চুক্তি প্রত্যাখ্যানে বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া

ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান জঁ ক্লদ ইয়ুঙ্কার।
ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান জঁ ক্লদ ইয়ুঙ্কার।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদের (ব্রেক্সিট) বিষয়ে আড়াই বছর আগে গণভোটেই মতামত দিয়ে দিয়েছিল যুক্তরাজ্যের জনগণ। ইইউর অন্য দেশগুলোকে টানতে গিয়ে তাদের পাউন্ড খরচ হয়ে যাচ্ছে—এমনটা মনে করে দেশের ৫২ শতাংশ মানুষ। এতে ইইউর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের চার দশকের সম্পর্কচ্ছেদের রায় হয়।

এরপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এই জোট থেকে কোন প্রক্রিয়ায় যুক্তরাজ্য আলাদা হবে এবং এরপর ইইউভুক্ত বাকি ২৭টি রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক কেমন হবে—এসব নিয়ে চলতে থাকতে আলোচনা–সমঝোতা। একটি খসড়া চুক্তি তৈরি করে থেরেসা মে সরকার। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার ইইউর সঙ্গে আলোচনা করে তৈরি করা চুক্তি নিয়ে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে ভোটাভুটিতে যান থেরেসা মে। বিশাল ব্যবধানে হেরে তিনি।

আসলে এমন অবস্থায় কী হতে যাচ্ছে, তার দিকে তাকিয়ে আছে সারা বিশ্বই। থেরেসা মে কি পারবেন চুক্তির নতুন খসড়া তৈরি করতে বা ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের সময় বাড়িয়ে নিতে? নাকি কোনো চুক্তি ছাড়াই আগামী ২৯ মার্চ ২৭টি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে ব্রিটেনকে?

বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে ইইউ ও বিভিন্ন দেশের নেতাদের প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে।

ইইউর প্রতিক্রিয়া
পার্লামেন্টে থেরেসা মের এমন হারের পর এক প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক বলেন, যুক্তরাজ্যের উচিত হবে ইইউর সঙ্গে থেকে যাওয়া। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, যদি ব্রেক্সিট চুক্তি অসম্ভব হয়, আবার কেউ যদি চুক্তি না হোক—এমনটা না চান, তাহলে শেষ পর্যন্ত একটি ইতিবাচক সমাধান বলার সাহস রয়েছে কার?

গতকাল ইইউর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের পথরেখার যে পরিকল্পনা থেরেসা মে পার্লামেন্টে উপস্থাপন করেছিলেন, ৬৫০ সদস্যের পার্লামেন্টে তা ৪৩২-২০২ ভোটে প্রত্যাখ্যাত হয়। ইইউর কর্মকর্তারা এবং রাজনীতিবিদরা হতাশা নিয়ে এর প্রতিক্রিয়া জানান। যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে কোনো ক্ষমতাসীন দলের নিম্নকক্ষে এটাই সবচেয়ে বড় হার। বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন থেরেসা মে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। চুক্তি পাসে ব্যর্থ হওয়ার খবর আসামাত্রই তিনি অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এখন এই আস্থা ভোটের দিকেই সবার নজর। আজ বুধবারই এই আস্থা ভোট হতে পারে।

ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান জঁ ক্লদ ইয়ুঙ্কার সতর্ক করে বলেছেন একটি চুক্তিতে যাওয়ার সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাজ্যের জন্য। তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুক্তরাজ্যকে তার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। সময় প্রায় শেষ হয়ে আসছে।’ তিনি আরও বলেন, আজ সন্ধ্যার ভোটের পর অগোছালোভাবে একটা বিচ্ছেদ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে গেল।

ব্রেক্সিট ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষের প্রধান আলোচক মাইকেল বার্নিয়ার বলেন, যুক্তরাজ্যকে তার পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, এখন কী করা হবে, তা ব্রিটিশ সরকারের ওপর নির্ভর করছে। ইইউ ঐক্যবদ্ধই থাকবে এবং একটি চুক্তিতে যাওয়ার জন্য দৃঢ় থাকবে।

জার্মানির প্রতিক্রিয়া
জার্মানির অর্থমন্ত্রী ও ভাইস চ্যান্সেলর ওলাফ শলত্‍স গতকাল তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আজ দিনটি বিষণ্ন দিন ইউরোপের জন্য। আমরা ভালোভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। তবে মনে হচ্ছে, একটি কঠিন বিচ্ছেদ চুক্তিই সবচেয়ে আকর্ষণীয় পছন্দ হয়ে যাচ্ছে।’

ক্ষমতাসীন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট ইউনিয়ন পার্টির নেতা অ্যানেগ্রেট ক্রাম্প-কারেনবাওয়া এই বক্তব্যের সমর্থনে বলছেন, একটি কঠিন বিচ্ছেদ দুই পক্ষের জন্যই সবচেয়ে খারাপ হবে।

ফ্রান্সের প্রতিক্রিয়া
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ মনে করেন, সবচেয়ে বেশি চাপের মুখে পড়েছে যুক্তরাজ্য। তিনি সতর্ক করে বলেন, একটি পরিবর্তনের সময় অপরিহার্য কারণ কোনো চুক্তি না হওয়া ক্ষতিকর হবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পরিবর্তনের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় যেতে হবে। কারণ, ব্রিটিশরা এখন যে অবস্থায়, তাতে তারা এখন তরি ভেড়াতে বা ফিরিয়ে নিতে পারবে না।’

আয়ারল্যান্ডের প্রতিক্রিয়া
এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে আয়ারল্যান্ডের সরকার জানায়, কোনো চুক্তি ছাড়াই যুক্তরাজ্য বিচ্ছেদ করছে—এমন প্রস্তুতি তিনি নিতে শুরু করেছেন।

ব্রেক্সিট চুক্তির অন্যতম বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আলোচিত ৩৯ বিলিয়ন পাউন্ড ক্ষতিপূরণ কীভাবে পরিশোধ করবে যুক্তরাজ্য। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যে বসবাসরত জোটের অন্য দেশগুলোর প্রায় ৩২ লাখ মানুষের অবস্থান কী হবে বা ইউরোপের অন্য দেশগুলোয় থাকা যুক্তরাজ্যের প্রায় ১৩ লাখ নাগরিকের ভবিষ্যৎই বা কী হবে, এগুলোও চুক্তির মধ্যে ছিল। এগুলো ছাড়া যুক্তরাজ্যভুক্ত নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড এবং ইইউতে থেকে যাওয়া আয়ারল্যান্ডকে আলাদা করতে আবার কীভাবে সীমান্ত তুলতে হবে, তার মীমাংসা করা। এ চুক্তি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার মাধ্যমে দীর্ঘ প্রায় আড়াই বছরের বিতর্ক, সমঝোতা এবং দর-কষাকষির সবকিছুই ভেস্তে গেল।

মুদ্রাবাজার
এই ঘটনার পর মুদ্রাবাজারও প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছে। গতকাল দিনভর দর কমলেও আজ বুধবার ডলারের বিপরীতে বেড়েছে যুক্তরাজ্যের পাউন্ডের দর। আজ সকালে ডলারের বিপরীতে শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ বেড়ে যায় পাউন্ডের দর। ২০১৮ সালে ব্রেক্সিট নিয়ে অনিশ্চয়তায় মুদ্রাটি দর হারায় প্রায় ৮ শতাংশ। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, ইউরোর বিপরীতেই সামান্য দর বেড়েছে পাউন্ডের।

বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকারের এই হার মুদ্রাবাজারে খুবই প্রত্যাশিত ছিল। ২০১৮ সালে এই চুক্তি নিয়ে আলোচনার সময়ই সরকারের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন।

এ ঘটনায় হতাশ ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, আড়াই বছর ধরে চলা এই অনিশ্চয়তা শেষ হবে বলে ধৈর্য ধরে ছিলেন তাঁরা। এখন হতাশা ছাড়া আর কিছুই অনুভূত হচ্ছে না।

কনফেডারেশন অব ব্রিটিশ ইন্ডাস্ট্রিজ এক বিবৃতিতে জানায়, সব ব্যবসায় অনুভব করছে কোনো চুক্তি না হওয়া ভালো হয়নি। দ্রুত একটি নতুন চুক্তির পরিকল্পনা প্রয়োজন। এখনই সময় আমাদের রাজনীতিবিদের একটি ইতিহাস তৈরি করার।

জার্মান অটো ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন ভিডিএ তাদের প্রতিক্রিয়ার জানায়, আজকের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য তার দেশকে অসহায় করেছে। এখন একটি অনিয়ন্ত্রিত বিচ্ছেদ হবে বলেই মনে হচ্ছে। কোনো চুক্তি ছাড়া বিচ্ছেদ হলে তা মারাত্মক হবে।

আরও পড়ুন: