যে ভয়ে সৌদি ছেড়েছিলেন বাসমা

তথ্যচিত্র তৈরি করতে নিজের জন্মস্থান সৌদি আরব গিয়েছিলেন বাসমা খলিফা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
তথ্যচিত্র তৈরি করতে নিজের জন্মস্থান সৌদি আরব গিয়েছিলেন বাসমা খলিফা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

চিকিৎসক বাবার চাকরিসূত্রে সৌদি আরবে জন্ম নেন বাসমা খলিফা। এখন বয়স ২৯ বছর। বাবার কারণে শৈশব–কৈশোর বিভিন্ন দেশে কেটেছে সুদানি এই নারীর। তবে জন্মস্থান হওয়ায় সৌদির প্রতি অধিকারবোধ যেন একটু বেশিই ছিল তাঁর। ২৫ বছর পর আবার ফিরে গিয়েছিলেন সৌদি আরবের জীবনযাপন দেখতে। তবে সে অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি। কাজ ফেলে ভয়ে তাড়াহুড়ো করে তাঁকে ছাড়তে হয়েছিল সৌদি আরব। তিনি দেশটির সমালোচনা করেছেন, এমন অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে।

বাসমা খলিফা বিবিসির জন্য একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করছিলেন। বাসমা বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে যখন সৌদি আরব ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন তিনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। তাঁকে বলা হলো, নারীদের গাড়ি চালনার অধিকার নিয়ে আন্দোলন করা অধিকারকর্মীদের নিয়ে তিনি যেন কথা না বলেন। দুশ্চিন্তা ও ভীতি তাঁকে ভর করল। ঘটনাটি এত আকস্মিকভাবে ঘটেছিল যে কিছু চিন্তা করারও সময় পাননি তিনি। চোখে জল নিয়ে ছেড়েছিলেন সৌদি আরব।

সৌদি আরবে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখে পড়া বাসমা খলিফার ‘হোয়াই আই হ্যাড টু লিভ সৌদি আরব’ (আমাকে কেন সৌদি আরব ছাড়তে হলো) লেখাটি বিবিসি অনলাইন প্রকাশ করেছে।

বাসমা বলেন, ‘সাহস করে থেকে গেলে তারা আমার ভিসা বাতিল করতে পারত। সেদিনই একটি ফ্লাইটে করে লন্ডনে নিজ বাড়িতে ফিরে আসি।’

২৫ বছর আগে যখন সৌদি আরব ছিলেন বাসমা, তখন তিনি শিশু। গত বছর তিনি শেষবার যখন গেলেন তখন সেখানের সৈকত, মল ও ব্যয়বহুল রেস্তোরাঁ দেখে অবাক হয়ে যান। তিনি ছয় দিন ছিলেন। পুরো সময়টা বৃষ্টি ছিল, সৌদি আরবের জন্য এমন বৃষ্টি বিরল ঘটনা। তাঁকে কৌতুক করে বলা হচ্ছিল, লন্ডন থেকে বৃষ্টি নিয়ে সৌদি এসেছেন তিনি।

শুটিং বন্ধ রেখে বাসমা খলিফাকে লন্ডনে ফিরতে হয়। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
শুটিং বন্ধ রেখে বাসমা খলিফাকে লন্ডনে ফিরতে হয়। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

বাসমা বলেন, সৌদি আরবে ১৯৮৯ সালে তিনি জন্ম নেন। রাজধানী রিয়াদে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেন। তাঁর বয়স যখন তিন বছর, বাবা আয়ারল্যান্ডে চাকরি নিয়ে পুরো পরিবারসহ সৌদি আরব থেকে চলে যান। ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত আয়ারল্যান্ডে থাকার পর তাঁরা স্কটল্যান্ডে চলে যান। সেখানে ২০ বছর বয়স পর্যন্ত ছিলেন। এরপর ফ্যাশনবিষয়ক কাজের জন্য বাসমা ছয় মাস নিউইয়র্কে থাকেন। ২১ বছর বয়স থেকে তিনি লন্ডনে থাকা শুরু করেন এবং ফ্যাশন স্টাইলিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন।

বাসমার ভাষায়, যখন আপনি বারবার স্থান পরিবর্তন করবেন, তখন আপনার বাড়ি সম্পর্কে খুব জোরালো কোনো অনুভূতি কাজ করবে না। এটা আশীর্বাদ হতে পারে, অভিশাপও হতে পারে। আপনি যেকোনো জায়গাকে আপনার বাড়ি মনে করতে পারেন অথবা কোনো জায়গাকেই আপনার নিজের বাড়ি বলে মনে না হতে পারে। তবে এত বেশি স্থান পরিবর্তনের কারণে তিনি নতুন মানুষ ও নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারেন। বিশ্বজুড়ে তাঁর বন্ধু রয়েছে।

নিজের বাড়ি সম্পর্কে অনুভূতি উপলব্ধি করার প্রয়োজনে বাসমা আবার ফিরে যান সৌদি আরবে। সেখানে তাঁর তিন খালার বাসা রয়েছে। সৌদি আরব সম্পর্কে গণমাধ্যমে ব্যাপক নেতিবাচক খবর প্রকাশ হয়। কিন্তু পরিস্থিতি আসলেই কী, তা জানার জন্য হাজির হন তাঁর জন্মস্থান সৌদি আরবে। দেশটিতে তাঁর ফেরা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে তথ্যচিত্র বানানোর জন্য ই–মেইলে অনুরোধ জানান তিনি। এ নিয়ে দুই বছর ধরে পরিকল্পনা করেন তিনি। শেষে বিবিসি সাড়া দেওয়ায় পরিচালক জেসকে সঙ্গে নিয়ে সৌদি আরবে যান বাসমা।

সৌদি আরবে এক পার্টিতে বাসমা খলিফা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
সৌদি আরবে এক পার্টিতে বাসমা খলিফা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

মধ্যপ্রাচ্যে ঝুঁকি রয়েছে, এমন কোনো কিছু তিনি করতে চাননি বলে জানান বাসমা। তিনি বলেন, ‘আমার উদ্দেশ্য ছিল, পশ্চিমা ও আরব সংস্কৃতিতে দিন যাপন করা আমি যদি সৌদি আরবে একজন তরুণী হিসেবে বাস করতাম, তাহলে জীবন কেমন হতো। আমি দৈনন্দিন কাজ করে দেখাতে চেয়েছিলাম। যেমন কেনাকাটা, খাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা। সৌদি আরব এখন নারীদের গাড়ি চালানোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে, আমি এই নতুন স্বাধীনতার সুযোগ নিতে সেখানে গাড়ি চালাতে চেয়েছিলাম।’
বাসমা বলেন, ‘আমি জানতাম যে সৌদি আরবের জীবন ভিন্ন। নারীদের সেখানে অধিকার কম। যেমন নারীরা পুরুষের অনুমতি ছাড়া দেশ ছাড়তে পারেন না, ব্যাংক হিসাব খুলতে পারেন না। রেস্তোরাঁয় পুরুষের কাছ থেকে আলাদা জায়গায় বসতে হয়।’

বাসমা বলেন, এসব বিধিনিষেধ সত্ত্বেও দেশটিতে পরিবর্তন আসছে। মাথা স্কার্ফ দিয়ে না ঢেকেও নারীরা সেখানে ঘুরতে পারেন। সামাজিক মেলামেশা আরও অবাধ হয়েছে। নারীরাও পেশা নিয়ে ভাবতে পারেন। এরপরও দেশটি তার হাতের মুঠোয় রাখে সবকিছু এবং বিরোধী মত কঠোরভাবে দমন করে। তিনি সৌদি আরবে থাকার সময় ২ অক্টোবর সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসগির নিখোঁজ হওয়ার খবর বের হয়। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবন থেকে নিখোঁজ হন তিনি। পরে জানা যায়, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।

এই ভয়াবহ ঘটনার পরও বাসমা ভয় পাননি। তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি তো সাংবাদিক হিসেবে সৌদি আরব যাননি। তিনি নির্মাতা হিসেবে গেছেন। সেখানে তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। দুই সপ্তাহের কাজ নিয়ে যাওয়ার সময় একবার তাঁর মনে হয়েছিল, ‘এটা কী করলেন, কেন এলেন?’ তবে খালাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তাঁর সেই আশঙ্কা দূর হয়ে যায়। তাঁর খালা সেখানে সফল একজন নারী। খালা তাঁকে ভাবতে সাহায্য করছিলেন যে সৌদি আরবে থাকা যায়।

সৌদি আরবে গিয়ে খালারা ছাড়াও অন্য লোকদের সঙ্গেও তাঁর মেলামেশা হয়। সৌদি কর্তৃপক্ষ তাঁদের সঙ্গে একজন তত্ত্বাবধায়ক দিয়ে দিয়েছিলেন, যিনি খেয়াল রাখতেন বাসমা ও তাঁর দল সৌদি রীতিনীতি মানছেন কি না। তাঁদের সঙ্গে একটি সৌদি প্রোডাকশন দলও ছিল—একজন গাড়িচালক, ক্যামেরা সহকারী এবং দুজন কর্মী। তত্ত্বাবধায়ক যতটা খবরদারি করবেন বলে ভেবেছিলেন বাসমা, ততটা করেননি। কিন্তু তাঁর কাছে ওই ব্যক্তিকে একজন উটকো ঝামেলা বলে মনে হতো। তত্ত্বাবধায়কের বিষয়টি বাদ দিলে তাঁরা সৌদির স্বাভাবিক জীবনযাত্রা দেখেছেন। মলে কেনাকাটা, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো।

এক সন্ধ্যায় বাসমা তাঁর বন্ধু, বন্ধুর বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর দলের লোকজনকে নিয়ে পার্টি করলেন। লন্ডনের পার্টিগুলো থেকে তা কিছুটা আলাদা ছিল। এই পার্টিতেও মেয়েরা মেকআপ করে সুন্দর পোশাকে সজ্জিত ছিল, তবে লন্ডনের চেয়ে মার্জিত ছিল পোশাক, লোকজন তুলনামূলক বেশি রক্ষণশীল। মূল পার্থক্য ছিল পার্টিতে কোনো মদ ছিল না। সৌদি আরবে মদ খাওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাসমার মদের অভ্যাস নেই। যদি থাকত তবে তিনি ওই সফরে গিয়ে বড় বিপদে পড়তেন বলে মনে করেন।

বাবা–মায়ের সঙ্গে শিশু বাসমা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
বাবা–মায়ের সঙ্গে শিশু বাসমা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

ওই পার্টির পর একদিন তিনি তত্ত্বাবধায়ককে বললেন তিনি গাড়ি চালাতে চান। কয়েক বছর ধরে অধিকারকর্মীদের আন্দোলনের মুখে গত বছরের জুন মাসে সৌদি আরবে নারীদের গাড়ি চালানোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। সৌদি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ ঘটনা ঘটল। এ ঘটনাকে সৌদি আরবে বড় ধরনের সামাজিক পরিবর্তন হিসেবে দেখা হয়। যে দেশে এই সাধারণ একটি বিষয় থেকে নারীদের দীর্ঘ সময় ধরে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল, সেটার স্বাধীনতা পরখ করে দেখতে স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখেছিলেন বাসমা। তবে এ থেকেই ঘটে বিপত্তি। তত্ত্বাবধায়ক অন্য একটি গাড়ি থেকে তাঁকে একটি তার এনে দিয়েছিলেন, যাতে স্টেরিওর সঙ্গে তিনি নিজের ফোনের গান সংযোগ করতে পারেন। গাড়ি চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সময়েও অনেক নারী অধিকারকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনি সেটা নিয়ে লেখা এক নিবন্ধ জোরে জোরে পড়ছিলেন। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, ওই নারীরা মুক্তি পেয়েছেন কি না, কিন্তু তাঁর সন্দেহই সত্য নয়। ওই নারীরা তখনো কারাবন্দী ছিলেন।

বাসমা বলেন, ‘আমি যখন খবরটি পড়ছিলাম, তখন সৌদি আরবের ওই প্রোডাকশন দলের একজন তা শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। যে ইস্যুতে খবর, সে ব্যাপারে তাঁর রাগ ছিল না। তাঁর মনে হয়েছে, আমি সৌদি আরবের সমালোচনা করেছি। নারীদের সাহসিকতাকে উদ্‌যাপন করছি না, অথচ আমি তাই করেছিলাম।’

বাসমার অজ্ঞাতেই এ খবর চলে যায় ওই প্রোডাকশন দলরে বস এবং যুক্তরাজ্যে বাসমার প্রোডাকশন দলের কাছে। তিনি এতটাই বেদনাহত হন এবং ভয়ও পান। তিনি কারও অনুভূতিতে আঘাত করতে চাননি, কাউকে ছোট করতে চাননি। তিনি শুধু একটি খবর পড়েছেন। পৃথিবীর কোন গবেষণায় আছে যে এতে দোষ হয়!
যুক্তরাজ্য থেকে বাসমার সম্পাদক ফোন দেন যে তাঁকে এখনই সৌদি আরব ছাড়তে হবে। তিনি মাত্র ছয় দিন ছিলেন সেখানে। আরও কত কিছু করার পরিকল্পনা ছিল। নারী উদ্যোক্তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা ছিল। সব ফেলে তাঁকে তল্পিতল্পা বাঁধতে হলো।

বাসমা জানান, তিনি মনে করেননি তিনি এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হতে পারেন। কিন্তু তিনি কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। অশ্রু চোখে বিদায় জানালেন খালাদের। হিথরো বিমানবন্দরে নামার পর প্রথম তিনি হাঁপ ছাড়েন। তাঁর মনে হচ্ছিল, তিনি সৌদি নাগালের বাইরে পৌঁছেছেন। এর আগে কখনো ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নিয়ে তাঁর এত উচ্ছ্বাস হয়নি, ওই মুহূর্তে যেমন হয়েছিল। তবে সৌদি আরবে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও দেশটি নিয়ে আশাবাদী বাসমা। সৌদি আরবে অনেক ইতিবাচক ঘটনাও ঘটছে, যাতে বোঝা যাচ্ছে সেখানে সত্যিকারের পরিবর্তন আসবে। তবে তিনি সেখানে গিয়ে নিজ চোখে তা কখনো দেখতে পারবেন কি না, জানেন না।