ফুকুশিমা দাই-ইচির হালচাল

কারও সাজানো আবাসিক ভবন। আট বছর আগে ঘরদুয়ার ঠিক এভাবে ফেলে রেখে মালিক সরে গেছেন। ছবি: মনজুরুল হক
কারও সাজানো আবাসিক ভবন। আট বছর আগে ঘরদুয়ার ঠিক এভাবে ফেলে রেখে মালিক সরে গেছেন। ছবি: মনজুরুল হক
>পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনার আট বছর পর সেখানকার পরিস্থিতি এখন কী রকম, তা দেখার সুযোগ করে দিতে জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছুদিন আগে টোকিওতে অবস্থানরত ১২ জন বিদেশি সাংবাদিককে ফুকুশিমা দাই-ইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিল। সেই দলে ওয়াশিংটন পোস্ট, ফরাসি দৈনিক লিবারেসনের মতো সংবাদপত্র, জার্মান বেতার ও হংকংয়ের চীনা ভাষার সাময়িকীর পাশাপাশি ‘প্রথম আলো’ও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

জাপানের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার ৮ বছর পূর্তি হবে আর কিছুদিন পর। ২০১১ সালের ১১ মার্চ প্রচণ্ড এক ভূমিকম্প থেকে শুরু হওয়া সুনামি জলোচ্ছ্বাস জাপানের ফুকুশিমা জেলার ওকুমা গ্রাম ও ফুতাবা শহর ঘিরে অবস্থিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারটি পারমাণবিক চুল্লিকে প্লাবিত করে কেন্দ্রের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এতে সূচনা হয়েছিল সাম্প্রতিক সময়ে জাপানের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের।

নিশান মোটরের বিক্রয়কেন্দ্র এখন পরিত্যক্ত এক স্থাপনা। ছবি: মনজুরুল হক
নিশান মোটরের বিক্রয়কেন্দ্র এখন পরিত্যক্ত এক স্থাপনা। ছবি: মনজুরুল হক

পরমাণু চুল্লির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত ইউরেনিয়াম রড বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রচণ্ড গরম হয়ে গেলে সেগুলোকে শীতল করার জন্য নির্মিত বিশেষ জলাধারে বিরতিহীনভাবে ঠান্ডা পানি সরবরাহ করে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া চলাকালেও চুল্লি যেন প্রচণ্ড উত্তাপে গলে না যায়, সে জন্য সেটিকেও বিশেষ ব্যবস্থায় পানি প্রবাহিত করার মধ্য দিয়ে শীতল রাখতে হয়। এই ব্যবস্থায় ত্রুটি দেখা দিলে এর পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। আর সে জন্য প্রতিটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে শীতলীকরণের একটি ব্যবস্থা বিকল হয়ে গেলে প্রক্রিয়া চালু রাখার জন্য বিকল্প একটি ব্যবস্থাও তৈরি রাখতে হয়।

রেস্তোরাঁ এখনো দাঁড়িয়ে, সাইনবোর্ডও আছে। নেই শুধু ক্রেতা কিংবা বিক্রেতা। ছবি: মনজুরুল হক
রেস্তোরাঁ এখনো দাঁড়িয়ে, সাইনবোর্ডও আছে। নেই শুধু ক্রেতা কিংবা বিক্রেতা। ছবি: মনজুরুল হক

ফুকুশিমা দাই-ইচি বিদ্যুৎকেন্দ্রেও সে রকম একটি বিকল্প ঠিক রাখা ছিল। তবে সুনামির ঢেউ যে বিশাল আকার আর প্রচণ্ড গতি নিয়ে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিতে পারে, সেই হিসাব বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালক কোম্পানি টেপকো শুরুতে করতে পারেনি। তাই সুনামির আঘাতে মূল ও বিকল্প—দুই শীতলীকরণ ব্যবস্থাই অকার্যকর হয়ে পড়লে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছয়টি চুল্লির মধ্যে দুটিতে বিস্ফোরণ ঘটে এবং অন্য দুটি থেকেও প্রচুর পরিমাণ হাইড্রোজেন নির্গত হয়ে বাতাসে মিশে যায়। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তেজস্ক্রিয় দূষণ বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়লে জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক ঝুঁকি হিসেবে তা দেখা দিয়েছিল।

পথের ধারের আরেকটি বাড়ি। রাত নেমে এলে এটি হয়ে ওঠে ভুতুড়ে বাড়ি! ছবি: মনজুরুল হক
পথের ধারের আরেকটি বাড়ি। রাত নেমে এলে এটি হয়ে ওঠে ভুতুড়ে বাড়ি! ছবি: মনজুরুল হক

ফলে চুল্লি নিয়ন্ত্রণে আনার বাইরেও জরুরি ভিত্তিতে আরও যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তা হলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারপাশের ১০ থেকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া। অনেকটা তাৎক্ষণিক নোটিশে তাঁদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়েছিল এবং তাঁরা যেন সঙ্গে করে কোনো কিছু বহন না করেন, সেই নির্দেশও তাঁদের দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে অনেকেই প্রায় এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে অনেক দূরের নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে উঠেছিলেন। হঠাৎ করে বাস্তুহারা হয়ে পড়া সেসব মানুষের অনেকেই শুরুতে ভেবেছিলেন, তাঁদের সেই বাড়িঘর ছেড়ে আসার মেয়াদ হয়তো হবে ক্ষণস্থায়ী এবং আবারও তাঁরা নিজেদের গোছানো সংসারে ফিরে যেতে পারবেন। তবে দুর্ঘটনার ৮ বছর পর ৪৪ হাজারের বেশি মানুষ এখনো অন্যত্র বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁদের আগের সেই গোছানো সংসার এখন বিরানভূমি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে প্রবেশাধিকার নেই জনমানুষের।

ফাস্ট ফ্যাশন হিসেবে খ্যাত শিমামুরার তৈরি পোশাকের দোকানে এখনো হ্যাঙ্গারে ঝুলছে বিক্রির সব পোশাক। ছবি: মনজুরুল হক
ফাস্ট ফ্যাশন হিসেবে খ্যাত শিমামুরার তৈরি পোশাকের দোকানে এখনো হ্যাঙ্গারে ঝুলছে বিক্রির সব পোশাক। ছবি: মনজুরুল হক

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার অনেকটাই দৃষ্টির আড়ালে থেকে যাওয়ার বিষয়টি খুবই মর্মান্তিক। মানুষের বাড়িঘর তো শুধু রাত্রিযাপন আর অবসর সময় কাটানোর জায়গা নয়। বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নানা রকম স্মৃতি। ছবির অ্যালবাম, শখের নানা সংগ্রহ, পছন্দের পোশাক—সবই আমাদের জীবনকে করে তোলে অর্থবহ। হঠাৎ করে এর সবকিছু ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যেতে বলা হচ্ছে ভয়ংকর রকমের অমানবিক—যার গভীরতা বাইরে থেকে সেভাবে আঁচ করা হয়তো সম্ভব নয়। কেবল বাড়িঘর নয়, ছোট ছোট জনপদে গড়ে ওঠা দোকানপাট ও রেস্তোরাঁও মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিশে বন্ধ করে দিয়ে মালিকদের বলা হয় সেখান থেকে সরে যেতে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ঝাঁপ গুটিয়ে নেওয়ার সময়ও পাননি। নিরাপদ আশ্রয়ে দ্রুত সরে যেতে হওয়ায়, পেছনে ফেলে গেছেন তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ঘর-সংসার। এর সবকিছুই দুর্ঘটনার ৮ বছর পরও পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোনো দুর্ঘটনা কতটা ব্যাপক আকার নিতে পারে।

পরিত্যক্ত পাচিঙ্কো পারলার। ছবি: মনজুরুল হক
পরিত্যক্ত পাচিঙ্কো পারলার। ছবি: মনজুরুল হক



প্রায় ৪৪ হাজার মানুষ আজও ফিরে যেতে পারছেন না নিজেদের বাড়িঘরে। তাঁদের প্রায় সবার বাস ছিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১০ কিলোমিটার ব্যাসের মধ্যে। সেখানকার অনেক বসতি আজও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। কবে সেখানে আবারও মানুষের পদার্পণ ঘটবে—তার কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছেন না। নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকা ঘরবাড়ি, পেট্রল পাম্প, রেস্তোরাঁ, দোকানপাট, সিনেমা হল আর গেম সেন্টার বলছে সেই ট্র্যাজেডির কথা, যার পুরোটাই মানুষের তৈরি।

এই জনপদ একসময় মানুষের পদচারণে মুখরিত ছিল। ছবি: মনজুরুল হক
এই জনপদ একসময় মানুষের পদচারণে মুখরিত ছিল। ছবি: মনজুরুল হক