তালেবান থেকে যেভাবে রক্ষা পেলেন তিনি

হোটেল কক্ষের এই বিছানার নিচে লুকিয়ে রক্ষা পেয়েছিলেন পাইলট ভাসিলাইউস ভাসিলাইউ। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
হোটেল কক্ষের এই বিছানার নিচে লুকিয়ে রক্ষা পেয়েছিলেন পাইলট ভাসিলাইউস ভাসিলাইউ। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

২০১৮ সালের ২০ জানুয়ারি। গ্রিক পাইলট ভাসিলাইউস ভাসিলাইউ আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে পাহাড়ের চূড়ায় বিলাসবহুল হোটেল দ্য ইন্টারকন্টিনেন্টালে উঠেছেন। ওই সময় তিনি আফগান বিমান ‘কাম এয়ার’-এর পাইলট ছিলেন। হোটেলটি বিদেশিদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। হয়তো এ কারণেই তালেবানদের ধ্বংসযজ্ঞের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয় সেটি।

ফ্লাইটের বিরতিতে ভাসিলাইউস যেদিন ইন্টারকন্টিনেন্টালে ওঠেন, সেদিনই তালেবান জঙ্গিরা তাণ্ডব চালায়। তালেবান হামলায় সেদিন সৌভাগ্যক্রমে রক্ষা পান ভাসিলাইউস। ওই ভয়ংকর ঘটনার এক বছর পর এ নিয়ে বিবিসি অনলাইনে লেখেন তিনি। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে—কীভাবে প্রায় ১৫ ঘণ্টা তিনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। একটি বিছানা কীভাবে তাঁকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করেছিল।

ভাসিলাইউস জানান, সেদিন সন্ধ্যায় ছয়টায় রাতের খাবার খেতে ওই হোটেলের রেস্তোরাঁয় যান। সঙ্গে ছিলেন তাঁর বন্ধু পাইলট মাইকেল পউলিকাকস। তিন-চার মাসের মধ্যে যতবার হোটেলটিতে তিনি উঠেছেন, সেদিনই প্রথম তিনি এত তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেতে যান। সাধারণত তিনি আটটার দিকে রাতের খাবার খান। সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় খাওয়া শেষ করে তিনি কক্ষে ফিরে আসেন। তাঁর কক্ষটি ছিল ছয়তলা হোটেলের একদম ওপরের তলায়—৫২২ নম্বর।

কক্ষে ফিরে আসেন জরুরি কিছু ফোন সারতে। পৌনে নয়টার দিকে হঠাৎ বড় ধরনের বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। ওই সময় তিনি এথেন্সের একটি ফোনকলে কথা বলছিলেন। শব্দ শুনে কী হয়েছে, দেখার জন্য বারান্দায় যান। একজন মানুষের রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকতে দেখেন। হোটেলের ভেতর ও বাইরে থেকে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ চলছে। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয় যে আগেভাগে রাতের খাবার খেয়েছিলেন। তা না হলে এখন তিনি রেস্তোরাঁয় থাকতেন। নিজেকে বলতে থাকেন, ‘ঠিক আছে ভাসিলাইউস, বেঁচে থাকার জন্য তোমাকে কিছু করতেই হবে।’

বন্ধু পাইলট মাইকেল পউলিকাকসের সঙ্গে ভাসিলাইউস। তাঁর দুজনেই আফগানিস্তানের কাম এয়ারের পাইলট ছিলেন। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
বন্ধু পাইলট মাইকেল পউলিকাকসের সঙ্গে ভাসিলাইউস। তাঁর দুজনেই আফগানিস্তানের কাম এয়ারের পাইলট ছিলেন। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

দ্রুত চিন্তা করতে থাকেন ভাসিলাইউস। বারান্দার দরজা খোলা রেখেই কক্ষে ঢোকেন এবং কক্ষ থেকে বাইরে যাওয়ার দরজা ভেতর থেকে তালা দিয়ে দেন। কক্ষে দুটো বিছানা ছিল। একটি বিছানার ম্যাট্রেস তুলে নিয়ে তিনি দরজার কাছে রাখেন যাতে গ্রেনেড হামলা থেকে বাঁচতে পারেন। এরপর তিনি কয়েকটি বিছানার চাদর, তোয়ালে ও কাপড় একসঙ্গে করে সেগুলো দিয়ে একটি দড়ি বানান। যাতে প্রয়োজন হলে তিনি পঞ্চম তলায় নেমে যেতে পারেন।

ভাসিলাইউস বলেন, ‘আমি একজন পাইলট ও প্রশিক্ষক। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পড়াশোনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজ করছি বছরের পর বছর ধরে। ফলে, অভ্যাসবশত রেস্তোরাঁয় বা থিয়েটারে গেলে দরজার পাশে অথবা জরুরি নির্গমন পথের কাছের আসনে বসি। এরপর কী করব, সেই চিন্তা করতে থাকলাম দ্রুত। হামলাকারী কয়জন বা ভবনের কোথায় তারা, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। ছয়তলা থেকে লাফিয়ে নিচে পড়াও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাই নিজেকে বলা শুরু করলাম, কক্ষের ভেতরেই থাকো এবং যতটা পারো নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করো। কী কারণে জানি না, আমি অপ্রত্যাশিতভাবে শান্ত রইলাম।’

কক্ষের আলো নিভিয়ে ভাসিলাইউস ভারী পর্দা ও আসবাবপত্রের আড়ালে লুকিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। দেড় ঘণ্টা পার হয়েছে। তিনি তখনো জানতেন না, নিচতলায় লবি, রেস্তোরাঁ এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার প্রায় প্রত্যেককেই হত্যা করা হয়েছে। হামলাকারীরা সেখানে হত্যাযজ্ঞ শেষে ওপরের দিকে ওঠা শুরু করেছে। তাঁর মাথার ওপর ছাদে হামলাকারীদের দৌড়াদৌড়ির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। সেখানে তারা ইন্টারকন্টিনেন্টালের নিজস্ব বাহিনীর হেলিকপ্টারের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছিল। এর কিছু পরেই ষষ্ঠ তলায় তাঁর কক্ষের সঙ্গের করিডরে গুলির শব্দ শুনতে পান। হঠাৎ হোটেলের সব বৈদ্যুতিক আলো নিভে যায়।

ভাসিলাইউস টের পান, হামলাকারীরা পাশের ৫২১ নম্বর কক্ষে ঢুকছে। কক্ষটি তাদের রাতভর অভিযান পরিচালনার কেন্দ্রে পরিণত হয়।

ভাসিলাইউসের কক্ষের দরজায় গুলি করা হলে তিনি ভাবতে থাকেন, তিনি যেখানে লুকিয়েছেন, সেটা খুব একটা ভালো জায়গা হয়নি। তিনি জায়গা বদল করলেন। যে বিছানায় ম্যাট্রেস আছে, সেটির নিচে ঢুকে পড়লেন। দুই হাতের তালু ঠেকিয়ে তিনি বিছানাটা কিছুটা উঁচু করে ধরেছিলেন। আর বিছানার ওজনের ভারসাম্য রাখতে পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর ভর দেন। বিছানার নিচে ফাঁক দিয়ে খুব সামান্যই তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন। মাত্র ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত তিনি উঁচু করে ধরেছিলেন বিছানাটি। সেই ফাঁক দিয়ে দেখলেন, গুলি করে ও হাতুড়ি দিয়ে তালা ভেঙে কক্ষে ঢুকছে চার হামলাকারী। বারান্দার দরজা খোলা দেখে একজন দ্রুত সেদিকে ছুটল।

ভাসিলাইউস পিস্তলের গুলির একটি শব্দ শুনলেন। ভাবছিলেন আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনি মরতে যাচ্ছেন। চোখের সামনে ভেসে উঠল পরিবার আর সন্তানদের মুখ। জীবনের সুখের ও কষ্টের ঘটনাগুলো মনে পড়তে লাগল। তাঁর কক্ষের দরজাটি খোলাই রইল। হামলাকারীরা আসা-যাওয়া করতে লাগল কক্ষে। ষষ্ঠ তলায় তাঁর পাশের কক্ষগুলোতে তাঁর সহকর্মী কয়েকজন পাইলট ও স্টুয়ার্ড ছিলেন। মাঝেমধ্যে তাঁদের হত্যা করার আগে কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। মাঝেমধ্যে চারপাশ ছিল সুনসান। তাঁর মনে হলো, ওই ফ্লোরের প্রতিটি কক্ষে হামলাকারীরা ঢুকে যাদের পেয়েছে, তাদেরই হত্যা করেছে। প্রতিবার হত্যার পর হামলাকারীরা হাসছিল। যেন এটা একটি খেলা অথবা বড় ধরনের কোনো পার্টি বা আর কিছু।

ডান পাশে ৫২০ নম্বর কক্ষ। এরপর ৫২১ এবং পরেরটি ৫২২ নম্বর কক্ষে ছিলেন ভাসিলাইউস। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
ডান পাশে ৫২০ নম্বর কক্ষ। এরপর ৫২১ এবং পরেরটি ৫২২ নম্বর কক্ষে ছিলেন ভাসিলাইউস। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

দিবাগত রাত তিনটার দিকে হামলাকারীরা ষষ্ঠ তলায় আগুন লাগাল। অনেক বেশি ধোঁয়া হওয়ায় তারা ওই ফ্লোর থেকে নেমে গেল। ২০ থেকে ২৫ মিনিট পর্যন্ত কোনো গুলিবর্ষণ না হওয়ায় তিনি বিছানার নিচ থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি দেখলেন যে বিছানা থেকে তিনি ম্যাট্রেস বের করে নিয়েছিলেন, সেটিতে গুলি করেছিল হামলাকারীরা। তারা বিছানাটি উল্টেও দেখেছিল কেউ লুকিয়ে আছে কি না।

ভাসিলাইউস বলেন, ‘মনে হলো আজ দ্বিতীয়বার আমি জীবন নিয়ে পালালাম। এর আগে থেকেই কক্ষটিতে ধোঁয়া ঢোকা শুরু করেছিল। আমি বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। বাঁ পাশে তাকিয়ে দেখলাম আগুনের লেলিহান শিখা। বুঝলাম, কক্ষে গেলে আমি বাঁচতে পারব না। ছাদ থেকে টিভির কিছু তার ঝুলে থাকতে দেখলাম। টেনে দেখলাম সেগুলো আমার ওজন নিতে পারবে কি না। ঠিক সেই সময় আমার ডান পাশ দিয়ে গুলি যায়। একটি আমার কাঁধ ঘেঁষে ২০ সেন্টিমিটার দূরত্ব দিয়ে এবং আরেকটি বুলেট যায় আধা মিটার দূরত্ব থেকে। আমার পেছনে জানালায় গিয়ে লাগে বুলেট দুটো।’

ভাসিলাইউসকে হামলাকারী ভেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি চালিয়েছিল বলে মনে হলো তাঁর। তারগুলো ধরার আগমুহূর্তে তৃতীয় গুলিটি মিস হলে তিনি কক্ষের ভেতরে চলে যান। ব্যাগ থেকে নখ কাটার কাঁচিসহ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে আবার বিছানার নিচে ঢুকে পড়েন। ছোট কাঁচি দিয়ে বিছানার নিচের কাঠের অংশ ঢেকে রাখা প্লাস্টিকে ছিদ্র করেন। ফ্রিজ থেকে বের করে নেওয়া দুই বোতল পানি ও দুধ এবং টি-শার্ট নিয়ে বিছানার নিচে ঢোকেন। টি-শার্ট কেটে ছোট ছোট টুকরো করেন। নাকের ফুটোয় কিছু টুকরো গুঁজে দেন যাতে ধোঁয়া ছেঁকে নিতে পারে। মুখে আরেক টুকরো কাপড় রেখে পানি ও দুধ ঢালেন, যাতে তা ডাবল ছাঁকনির কাজ করে। এসবই তিনি শিখেছিলেন এথেন্স আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দমকল বাহিনীর কাছ থেকে।

ভাসিলাইউস বিছানার নিচে থাকা অবস্থায় হামলাকারীরা ওই কক্ষে ফিরে এল। তিনি যখন বিছানার নিচে লুকিয়েছিলেন, তার ওপর বসেছিল একজন। তার পা দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। ওই লোক অন্যদের কী কী নির্দেশ যেন দিচ্ছিল। বারান্দায় গিয়ে ওই লোক একে ৪৭ ম্যাগাজিন দিয়ে গুলি করল।

ভাসিলাইউস বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছিল, আমি আজ বেঁচে যাব। তা না হলে আমি অন্যদিনের চেয়ে আগে রাতের খাবার খেতাম না। প্রথমবার হামলাকারীরা কক্ষে ঢুকে অন্য বিছানার দিকে গুলি করেছে, আমি বেঁচে গেছি। বারান্দায় গিয়েছিলাম, আমাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছে। আমি বেঁচে গেছি এবং আমি এখনো ভালোভাবেই লুকিয়ে আছি।’

আন্তর্জাতিক বাহিনী ভোরে ট্যাংক থেকে কক্ষগুলোয় হামলাকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে লাগল। তাঁদের লক্ষ্য ভাসিলাইউসের পাশের ৫২১ নম্বর কক্ষ, যেখানে ঘাঁটি গেড়েছিল হামলাকারীরা। কিন্তু হামলাকারীরা স্থান পাল্টাচ্ছিল বলে তারা অন্য কক্ষগুলো লক্ষ্য করেও গুলি করছিল। ট্যাংক থেকে যতবার গুলি করা হচ্ছিল, ততবার পুরো হোটেল কেঁপে উঠছিল। হামলাকারীরা তাঁর কক্ষের আলমারি থেকে কিছু কাপড়চোপড় ও কার্পেট নিয়ে তাতে ডিজেল দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয় ৫২১ নম্বর কক্ষে। পাশের কক্ষে এত বড় আগুন, ভাসিলাইউস বুঝলেন, এ পরিস্থিতিতে তিনি বড়জোর ১৫ থেকে ২০ মিনিট নিশ্বাস নিতে পারবেন। খুব বেশি হলে আধা ঘণ্টা।

কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি বিছানার নিচ থেকে বেরিয়ে আসেন। সঙ্গে সঙ্গে পাশের কক্ষের জানালা ভাঙার শব্দ পান। এরপর তাঁর কক্ষেরও জানালার কাচ ভাঙা শুরু হয়। নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠলেন তিনি। আগুন নেভাতে আন্তর্জাতিক বাহিনী পানি ছুড়ে মারছিল। তাতেই গ্লাস ভেঙে পড়ছিল। আগুন থেমে গেল কিন্তু শুরু হলো অন্য বিপদ। জানালা ও দরজা ছাড়া কক্ষে হু হু করে ঠান্ডা ঢুকতে শুরু করল। তখন তাপমাত্রা ছিল মাইনাস তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস। খুব শিগগির তিনি হাইপোথারমিয়ায় আক্রান্ত হবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা সোয়া ১১টা পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাহিনী গ্রেনেড ছুড়তে লাগল। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পাশের ৫২১ নম্বর কক্ষে থাকা এক হামলাকারী শুধু রইল। তাঁর অস্ত্র ফুরিয়ে গেছে। ব্লোটর্চ দিয়ে ওই লোক নতুন করে আগুন ধরানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ায় পারছিল না। তাঁর অবস্থা থেকে ভাসিলাইউস এতটাই উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন যে মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি আটকান। কয়েক মিনিটের মধ্যে ওই লোক চলে যায়।

হামলার পর ভাসিলাইউসের বারান্দার অবস্থা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
হামলার পর ভাসিলাইউসের বারান্দার অবস্থা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

ভাসিলাইউস বলেন, ‘আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। এর আগের দিন শেষরাত পর্যন্ত ফ্লাইট চালিয়েছি। এর ওই রাত ঘুমাতে পারিনি। ৩৫ থেকে ৪০ ঘণ্টা ধরে ঘুমাতে পারিনি। একটু পর লোকজন আসার শব্দ শুনতে পাই। তবে তারা খারাপ, না ভালো লোক, তা না বুঝে চুপচাপ যেখানে লুকিয়েছিলাম সেখানেই থাকি। বেলা ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে আফগান উচ্চারণে কেউ “পুলিশ” “পুলিশ” বলে যাচ্ছিলেন। আমি সাড়া দিইনি। এরপর ইংলিশ উচ্চারণে “পুলিশ” শুনতে পেয়ে বুঝতে পারি, এঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। বিছানার নিচ থেকে বেরিয়ে আসি। এক জায়গায় এক অবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে থাকার কারণে আমার বুকে ব্যথা করছিল। নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না।’

শেষ মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে ভাসিলাইউস বলেন, ‘ধোঁয়ায় আমার চেহারা পুরো কালো হয়ে গিয়েছিল। আমাকে দেখে চারজন কমান্ডার বন্দুক তাক করে নিচে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। একজন ফিসফিস করে বলেন, নিশ্চয় ভূত। ঠান্ডায় আমি জমে যাচ্ছিলাম, সেই অবস্থায় কোনো রকমে বললাম, আমি কাম এয়ারের ক্যাপ্টেন। দয়া করে গুলি করবেন না।’

কমান্ডাররা চোখের সামনে যা দেখছিলেন, তা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ভাসিলাইউসকে জিজ্ঞেস করলেন, কতক্ষণ তিনি এভাবে ছিলেন। জানানোর পর তাঁরা বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন বিছানাটির দিকে। এ সময় একজন বললেন, ‘আমি তোমাকে নিচে নিয়ে যাব। কিন্তু শোনো, তার আগে তোমার সঙ্গে একটি ছবি তুলতে দিতে হবে।’ ভাসিলাইউস বললেন, তিনিও ছবি তুলতে চান যাতে এই মুহূর্তটা মনে রাখতে পারেন।

ভাসিলাইউস ছিলেন ওই হোটেলের শেষ উদ্ধার হওয়া ব্যক্তি। হোটেলে আর কেউ জীবিত নেই বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। তাঁর পরিবারও ধরে নিয়েছিল, তিনি বেঁচে নেই। গ্রিসের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, জীবিত সবাইকে উদ্ধার করা হয়েছে। সেই তালিকায় ভাসিলাইউস নেই। উদ্ধারকাজ শেষ হওয়ার তিন-চার ঘণ্টা পর পরিবারকে ফোনে ভাসিলাইউস তাঁর বেঁচে থাকার খবর দেন। পরিবারের ওই আনন্দ প্রকাশকে তিনি এখনো ভাষায় বর্ণনা করতে পারেন না। ওই দিন তিনি হোটেল থেকে বেরিয়ে দেখেন, তাঁর বন্ধু পাইলট মাইকেলকেও জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। দুই বন্ধু হাসি-কান্নায় একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন। তবে ওই ঘটনায় হারিয়েছিলেনও অনেককে। পাইলট, স্টাফ, প্রকৌশলী, অনেকেই বেঁচে নেই।

ভাসিলাইউস বলেন, ‘আমি খুব ইতিবাচক মানুষ। ওই ঘটনার পর আরও বেশি ইতিবাচক হয়েছি। আমি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করি এবং যা পেয়েছি তার জন্য কৃতজ্ঞতা বোধ করি। জীবন একটি উপহার। যতক্ষণ পর্যন্ত জীবন আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তা উপভোগ করা উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘গ্রিসের সৈকতে বন্ধুদের সঙ্গে বসে সময় কাটানোর মুহূর্তে অনেককে অভিযোগ করতে শুনি। তাঁদের ভাষায়, আমাদের অর্থনৈতিক সংকট রয়েছে, এ কারণে আমরা অনেক আরাম-আয়েশ ভোগ করতে পারি না, যা আমাদের পাওয়া উচিত ছিল। আমি বলি, জীবন উপভোগ করো।’ তাঁর মতে, জীবনে শুধু কাজ, দুশ্চিন্তা আর খারাপ দিকগুলোর ওপর নজর না দিয়ে সুন্দর মুহূর্ত সৃষ্টি ও ভালো মানুষের সঙ্গে থাকার দিকে জোর দেওয়া উচিত। কারণ, জীবন অনেক সুন্দর।