যানজট ঠেকাতে গণপরিবহনে ফ্রি যাতায়াতের পরিকল্পনা লুক্সেমবার্গের!

ইউরোপের মধ্যে লুক্সেমবার্গে সবচেয়ে বেশি ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করে। ছবি: এএফপি
ইউরোপের মধ্যে লুক্সেমবার্গে সবচেয়ে বেশি ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করে। ছবি: এএফপি

বিশ্বজুড়ে যানজট মোকাবিলায় নানা কৌশল অবলম্বন করতে দেখা যায়। ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, পাতালরেল, ওভার ব্রিজ, আন্ডারপাসের মতো স্থাপনা যানজট ও জনগণের চাপ সামলানোরই কৌশল। বিশ্বের অনেক দেশই এসব কৌশল ব্যবহার করে। তবে এবার যানজট মোকাবিলায় ভিন্ন ধারার কৌশল নিয়েছে লুক্সেমবার্গ। ইউরোপের এই ছোট দেশটি যানজট মোকাবিলায় গণপরিবহনে বিনে পয়সায় যাতায়াত চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী বছর এটা কার্যকর করা হবে।

সম্প্রতি বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের ১ মার্চ থেকে ট্রেন, ট্রাম ও বাসে বিনে পয়সায় যাতায়াত করবে দেশটির মানুষ। এই সুবিধা পাবে সীমান্তে চলাচলকারী পৌনে দুই লাখ শ্রমিক এমনকি পর্যটকেরাও। প্রায় ছয় লাখ বাসিন্দার এই দেশটিতে বছরে প্রায় ১২ লাখ পর্যটকও এই সুবিধা পাবে।

গত চার দশকে লুক্সেমবার্গে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার জনসংখ্যা বেড়েছে। ১৯৯৮ সালে শ্রম খাতে নিয়োজিত (দেশি-বিদেশি) ছিল ১ লাখ ৬১ হাজার জন, ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ২৭ হাজার। ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ি চলে লুক্সেমবার্গে। কর্মস্থল বা গন্তব্যে ছুটতে ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি (কার) ব্যবহার করে। গণপরিবহন ব্যবহার করে মাত্র ১৯ শতাংশ মানুষ। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার যানজটের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। তাই সবাইকে গণপরিবহনমুখী করা গেলে যানজট কমে যাবে এবং স্বল্প বেতনের মানুষ উপকৃত হবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

গণপরিবহন ফ্রি করার সিদ্ধান্তকে প্রাথমিকভাবে একটি সামাজিক পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেছেন দেশটির গতিশীলতা ও গণপূর্তমন্ত্রী ফ্রানকোয়েস বাউস। তিনি বলেন, ধনী ও গরিবদের মধ্যে দূরত্ব কমানো এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য। নিম্ন মজুরির জনগণের জন্য পরিবহন খরচ একটা বড় বিষয়। এটি হলে প্রত্যেকের গণপরিবহনে যাত্রা সহজতর হবে।

এক নজরে লুক্সেমবার্গ

অবস্থান: ইউরোপ মহাদেশ ( প্রতিবেশী জার্মানি, ফ্রান্স ও বেলজিয়াম)
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী: জাভিয়ার বেটেল
জনসংখ্যা: ৬ লাখ ২ হাজার (২০১৮ সাল)
আয়তন: ২ হাজার ৫৮৬ বর্গকিলোমিটার
রাজধানী: লুক্সেমবার্গ সিটি
মুদ্রা: ইউরো

লুক্সেমবার্গ সম্পদশীল দেশ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু দারিদ্র্য সেখানে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ১৩ শতাংশ কর্মী এবং প্রায় ১০ শতাংশ পেনশনপ্রাপ্ত মানুষ দারিদ্র্যের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সম্প্রতি সেখানকার পুনর্নির্বাচিত সরকার বেশ কিছু সামাজিক আইনের অংশ হিসেবে বিনা মূল্যে গণপরিবহনে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ন্যাশনাল হোলসেল মার্কেটে কাজ করেন এম বারেক রাবিল। সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘পরিবহনে বিনা মূল্যে ভ্রমণের ধারণাটা দারুণ। এটি আমার মতো কম বেতনের জনগণ আরও ভালো কিছু করতে সহায়তা পাবে।’ তবে এই উদ্যোগের সমালোচনাও আছে। তা ছাড়া পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা ও নানা অসুবিধার কথাও বলছেন অনেকে। ফলে ব্যক্তিগত গাড়ি ফেলে মানুষ ফ্রিতে ট্রেন বা বাসে উঠবে কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। রেলওয়ে ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মাইলেন বিয়ানছি বলেন, ‘পরিবহনে বিনা মূল্যে ভ্রমণ ব্যবস্থা সম্ভবত সন্ত্রাসবাদ কর্মকাণ্ডকে বাড়িয়ে দেবে। সন্ত্রাসবাদ কর্মকাণ্ড বাড়ার আশঙ্কায় জনগণ এই পদক্ষেপকে কম গুরুত্ব দিচ্ছে।’

সরকারি ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে দেশটির ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ইউনিয়নগুলো। শঙ্কা প্রকাশ করে তারা বলছে, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে পরিবহন খাতের অনেক কর্মী চাকরি হারাবে। লুক্সেমবার্গ ইউনিভার্সিটির গবেষক কনস্ট্যান্স কার বলেন, গণপরিবহন ফ্রি করা জটিল বিষয়, তবে ভাড়ায় যাতায়াতে সমস্যার কিছু দেখি না। প্রধান সামাজিক সমস্যা হিসেবে আবাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, আবাসনের জন্য ভূমি সহজলভ্য করা হলে সেটাই হবে সমস্যার কার্যকর সমাধান। এমনকি এতে ভূমি মালিকেরাও সমর্থন জানাবে।

ফাতিমা ব্রাগা দিনের বেলায় বাসা-বাড়িতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন এবং সন্ধ্যায় অফিসগুলোতে কাজ করেন ন্যূনতম মজুরিতে। দুই কাজের ফাঁকে তাঁর পোষা কুকুরে দেখাশোনা করতে বাড়ি ফেরেন। তিনি বলেন, পরিবহন ফ্রি হলে আমার প্রচুর অর্থ বেঁচে যাবে।

নতুন কৌশল বাস্তবায়নে পরিবহন অবকাঠামো খাতে সরকার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। পরিকল্পনার আওতায় রেলওয়ের আধুনিকায়ন, সীমানা সংযোগ আরও উন্নত করা, নতুন ট্রেন-ট্রাম-বাস বিনিময় কেন্দ্র স্থাপন করা। এ জন্য ২০২৩ সালের মধ্যে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ হবে ২.২ বিলিয়ন ইউরো। পরিবহন খাতে এখনো ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার, নতুন পদ্ধতি চালু হলে সেটা আরও বাড়বে বৈকি। এই ধরনের পরিকল্পনা লুক্সেমবার্গেই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৩ সালে জানুয়ারি মাসে এস্তোনিয়ার রাজধানী তাল্লিনে ভিড় সামলানো এবং কম উপার্জনকারীদের সাহায্যার্থে গণপরিবহন ফ্রি করা হয়েছিল। বাসিন্দাদের নগরের সর্বত্র ভ্রমণে গ্রিন কার্ডের জন্য দুই ইউরো দেন। অবশ্য অবাসিন্দা ও পর্যটকদের ভাড়া দিয়েই চলাচল করতে হয়।

এ ছাড়া ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফ্রান্সের ডানক্রিক শহরের দুই লাখ বাসিন্দার জন্য বাস সার্ভিস ফ্রি করা হয়েছিল। এক মাসের মধ্যে দেখা গেল, কিছু রুটে ৫০ শতাংশ এবং অন্যান্য রুটে ৮৫ শতাংশ যাত্রী বেড়ে গিয়েছিল। জনগণও ভাড়ার চেয়ে বিনা মূল্যে পরিবহনে ভ্রমণকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটল তাল্লিন শহরে। পরিবহনে গড়ে ১০ শতাংশ ট্রিপ কমে গেল। নিজদের ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের পরিবর্তে গণপরিবহন ব্যবহার না করে প্রতিবাদ স্বরূপ পায়ে হেঁটে বা বাইকে করে তারা কর্মস্থলে বা গন্তব্যে ছুটেছিলেন এবং আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন।

বর্তমানে লুক্সেমবার্গের বাসিন্দারা সরকারের অন্যান্য সামাজিক বিষয়ের চেয়ে গণপরিবহন ফ্রি পদ্ধতির বিষয়ে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। পরিবহন খাতে এই পরিবর্তন সরকারে কর্তৃত্ববাদ নয়, বরং সদিচ্ছার প্রতিফলন বলেই মনে করছে তারা।

বাংলাদেশে এমনটা সম্ভব? ঢাকার গণপরিবহনে নিয়মিত যাতায়াতকারী বেসরকারি চাকরিজীবী ইমরুল কায়েস প্রথম আলোকে বলেন, ‘অল্প জনসংখ্যার দেশে এটা ফলপ্রসূ হতে পারে। ১৬/১৭ কোটি মানুষের দেশে এটা বাস্তবায়নে বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি দেওয়া সরকারের পক্ষে অসম্ভব।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো দেশের যে কোনো সিদ্ধান্ত হয় সেই দেশের অর্থনীতি ও মোট জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে। আমাদের দেশের অর্থনীতি ও জনসংখ্যার যে অবস্থা, তাতে গণপরিবহন ফ্রি করার মতো অবস্থায় আমরা নেই।’ তিনি বলেন, গণপরিবহন খাতে এক ধরনের ভর্তুকি আছে, রেলওয়েতেও ভর্তুকি দিতে হয়। এ কারণে গণপরিবহন ফ্রি করার পরিস্থিতি আমাদের নেই।