'সাত দিন নরকে ছিলাম'

বাবার ছবি হাতে কাজাখ নারী। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
বাবার ছবি হাতে কাজাখ নারী। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আইবোতা শেরিকের বাবাকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর এক বছর পার হয়ে গেছে, প্রিয় বাবার মুখটি একবারের জন্য দেখতে পায়নি মেয়েটি। বাবাকে খুঁজে পাওয়ার আশায় ঘুরেছে দ্বারে দ্বারে। কোনো হদিস নেই। এ কথা বলতে বলতে তাঁর দুই চোখ বেয়ে জলের ধারা বয়ে যায়। আইবোতা চীনে বাস করা কাজাখ মুসলিম।

আইবোতার ধারণা, সরকারের কথিত ‘ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারে’ নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাঁর বাবা কুদাইবারগেন শেরিককে। তাঁর অভিযোগ, প্রশিক্ষণকেন্দ্র বলা হলেও সেটি আসলে একধরনের কারাগার।

আইবোতা বলেন, ‘আমি জানি না কেন আমার বাবাকে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। তিনি তো চীনের আইনের কোনো লঙ্ঘন করেননি। তাঁকে আদালতেও তোলা হয়নি।’

কুদাইবারগেন শেরিক ছিলেন চীনের উত্তরাঞ্চলের শিনচিয়াং প্রদেশের তেচাং প্রিফেকচার শহরের ইমাম। এক বছর আগে সেই যে তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তাপর আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি তাঁর।

কাজাখস্তানের সবচেয়ে বড় শহর আলমাতিতে এখন থাকেন আইবোতা। প্রিয়জনদের ফিরে পেতে কাজাখ সরকারের সহায়তা চান তিনি। কেবল তিনি নন, আরও অনেক মানুষই এখন প্রিয়জনকে পেতে কাজাখ সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিটি জানায়, কট্টরপন্থী সন্দেহে শিনচিয়াংয়ের অন্তর্বর্তী শিবিরে ১০ লাখ মুসলিমকে বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরে আটকে রাখা হয়েছে।

চীনে বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ জাতিগত কাজাখ বাস করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর হাজার হাজার কাজাখ তেলসমৃদ্ধ কাজাখস্তানে চলে যান। চীনে নিজেদের আত্মীয়দের সঙ্গে তাঁদের এখন আর কোনো যোগাযোগ নেই। নুরবুলাত তুরসানজান উলু ২০১৬ সালে আলমাতিতে চলে যান। তিনি জানান, তাঁর বয়স্ক বাবা–মা চীন ছাড়তে পারেননি। কর্তৃপক্ষ তাঁদের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়ায় কাজাখস্তান চলে আসতে পারছেন না তাঁরা।

নুসুপকান উলু নামের এক ব্যক্তি জানান, চীনে নিজেদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ফোন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইচ্যাটেও কথা বলেন না কেউ। তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালে আমার শ্বশুর আমাদের বাড়িতে আসেন। তিনি আলমাতি থেকে চীনে তাঁর ছেলেকে ফোন দেন। ভালোমন্দ কথা হয় তাঁদের। এর অল্প কয়েক দিন পরই তাঁর ছেলে বাউরঝানকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি কাজাখস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাঁকে রাজনৈতিক ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।’

মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনে কোনো সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। আদালতেও তোলা হয় না তাদের।

ওরিনবেক ককসাইবেক একজন জাতিগত কাজাখ। বন্দিজীবনের কথা মনে করে এখনো কেঁপে ওঠেন তিনি। কয়েক মাস তাঁকে আটকে রাখা হয় ‘পুনঃ দীক্ষা কেন্দ্রে’। তিনি জানান, সাত দিন পুরো নরকের মধ্যে ছিলেন তিনি। তাঁর হাতে হাতকড়া পড়ানো হয়, বেঁধে রাখা হয় পা। তিনি বলেন, ‘তাঁরা আমাকে হাত-পা বেঁধে একটা গর্তে ফেলে দেয়। আমি হাত উঁচু করে ওপরের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলেই আমার মুখের ওপর পানি ছুড়ে মারা হয়। আমি চিৎকার করতাম। এরপর কী হয়, আমার মনে নেই। কত দিন আমি সেখানে আটকা ছিলাম আমার মনে নেই। সে সময় অনেক শীত ছিল। খুব ঠান্ডা লাগত আমার। তারা বলত, আমি নাকি দেশদ্রোহী। কারণ, আমার দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। আমার নাকি ঋণ আছে, জমি আছে। যার কোনোটাই সত্যি ছিল না।’

এর এক সপ্তাহ পরে ককসাইবেককে অন্য একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে তাঁকে চীনা ভাষা ও গান শেখানো হয়। তাঁকে বলা হয়, তিন হাজার শব্দ শিখতে পারলে তাঁকে যেতে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘চীনারা এই জায়গাগুলোকে ‘পুনঃ দীক্ষা কেন্দ্র’ বলে। তবে সত্যিই যদি তারা মানুষকে পড়াতে চায়, তাহলে হাতকড়া কেন পরিয়ে রাখে?’

বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ককসাইবেক সত্যি বলছেন কি না, তা আলাদাভাবে প্রমাণ করার কোনো উপায় ছিল না। তবে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা চীনে কাজাখদের নির্যাতনের বিষয়ে একই ধরনের বর্ণনাই দিয়েছে। এ বিষয়ে চীনে কাজাখস্তানের দূতাবাসের জন্য বিবিসি যোগাযোগ করলে তারা কোনো মন্তব্য করেনি। তবে চীনা কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে জানায়, ‘এগুলো ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার’, যার উদ্দেশ্য ‘সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থী পরিবেশ থেকে মুক্ত হওয়া।’

কাজাখ সরকার জানায়, চীনের নাগরিকদের ওপর যেকোনো সীমাবদ্ধতা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়, এতে হস্তক্ষেপ করা হবে না। তবে চীনে আটককৃত কাজাখদের সহযোগিতার চেষ্টা তারা করবে।

শিনচিয়াং চীনের সীমান্তবর্তী বৃহত্তম অঞ্চল। এর আয়তন ১৬ লাখ ৬৪ হাজার ৮৯৭ বর্গকিলোমিটার। শিনচিয়াংয়ের সীমান্ত ছুঁয়ে গেছে বড় আটটি দেশ। এগুলো হচ্ছে রাশিয়া, কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, মঙ্গোলিয়া, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান। এত বড় অঞ্চলের তুলনায় লোকসংখ্যা অনেক কম। বিবিসির সাম্প্রতিক তথ্যে বলা হয়েছে, সেখানকার লোকসংখ্যা ১ কোটি ৯০ লাখ। এর অর্ধেকই উইঘুর মুসলিম, যাঁরা হাজারো বছর ধরে সেখানে বাস করে আসছেন। এ ছাড়া কাজাখরাও এখানে বসবাস করে আসছেন।