জোট বেঁধে ভোট, বিজেপির কপালে ভাঁজ

নরেন্দ্র মোদি
নরেন্দ্র মোদি

ভারতের কলকাতা ও দিল্লিতে দু–দুটি বিরোধী সমাবেশ নয়, বিজেপিকে চাপে ফেলে দিল গতকাল বুধবার রাতে শরদ পাওয়ারের বাড়ির বৈঠক। বিজেপির মোকাবিলায় এই বৈঠকে জোট বেঁধে ভোটে লড়াইয়ের সিদ্ধান্তই বিরোধীদের মাস্টারস্ট্রোক। প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপির কপালের ভাঁজ গভীরতর করার ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তই মোক্ষম হয়ে উঠতে পারে।

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল যন্তর মন্তরে বিরোধী সমাবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ১৯ জানুয়ারি কলকাতা সমাবেশের সময়ই। তৃণমূল নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখনই জানিয়ে দেন, দিল্লি সমাবেশে তিনি অবশ্যই হাজির থাকবেন। কথা দেন অন্যরাও। ভোটের আগে সংসদের শেষ অধিবেশনের শেষ দিন বুধবার। বিভিন্ন দলের নেতা-নেত্রীরা সেদিন দিল্লিতে ছিলেন। কাজেই সমাবেশ টইটুম্বুর হওয়ারই কথা। আশা অনুযায়ী, দুপুরে যন্তর মন্তরের ছবিটাও ছিল যেন ঠিক কলকাতার ব্রিগেড সমাবেশের দ্বিতীয় সংস্করণ। বিরোধী নেতা-নেত্রীরা প্রত্যাশামতো বিজেপিকে রোখার সংকল্প নিলেন। বিজেপির কাছেও তা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ছিল গতকাল রাতে মহারাষ্ট্রের এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ারের বাড়ির বৈঠক, যেখানে জোট বেঁধে ভোটে লড়াইয়ের সিদ্ধান্তটি আচমকাই ঘোষিত হয়।

ধরনা মঞ্চেই শারদ পাওয়ার অন্যদের তাঁর বাড়িতে চা পানের আমন্ত্রণ জানান। সেই অনুযায়ী সমাবেশ সেরে গতকাল সন্ধ্যায় শরদ পাওয়ারের বাড়ি যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রবাবু নাইডু, ফারুক আবদুল্লা, অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা। কিছু সময় পর চন্দ্রবাবু, কেজরিওয়াল ও ফারুখ আবদুল্লা চলে যান। থাকেন পাওয়ার, প্রফুল্ল প্যাটেল ও মমতা। এই সময় আচমকাই জানা যায়, কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী আসছেন পাওয়ারের বাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে পাওয়ার অনুরোধ করেন চন্দ্রবাবু, ফারুক ও কেজরিওয়ালদের আরও একবারের জন্য তাঁর বাড়ি আসতে। নতুনভাবে শুরু হয় বৈঠক, রাহুলকে নিয়ে। রাত প্রায় ১০টায় সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন সবাই। সেখানেই জানানো হয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত। ভোটের আগে জোটবদ্ধ হবেন বিরোধীরা। তৈরি হবে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি বা ‘কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম’। কী থাকবে সেই কর্মসূচিতে, কী হবে জোটের নাম, তার খসড়া ঠিক করার দায়িত্ব রাহুল গান্ধীর। জোটে আসতে আগ্রহী নেতারা রাহুলকে তাঁদের প্রস্তাব পাঠাবেন। ১৫ দিন পর ফের বসবে বৈঠক। তখন সবকিছু চূড়ান্ত হবে।

এমনিতে সর্বভারতীয় রাজনীতি দুই শিবিরে বিভক্ত। বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ। সেই দুই জোট অটুট থাকলেও জোটের বাইরে রয়েছে বেশ কয়েকটা দল, যাদের প্রভাব উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এই দলগুলো পরিস্থিতি বিচারে কোনো না কোনো জোট সরকারকে সমর্থন দিয়েছে; কেউ কেউ সরকারের শরিক হয়ে, কেউবা বাইরে থেকে। কিন্তু গতকালের উদ্যোগ নতুনভাবে জোটবদ্ধ হওয়ার, যা ইউপিএর অস্তিত্বের বাইরে নতুন জোট সৃষ্টি করতে পারে। হঠাৎ কেন এই তাগিদ, প্রশ্ন সেটাই।

গতকাল সন্ধ্যায় পাওয়ারের বাড়িতে উপস্থিত বিরোধী নেতাদের উপলব্ধি, বিজেপি যত খারাপ ফল করুক না কেন, ভোট শেষে তারাই হবে একক বৃহত্তম দল। ২০১৪ সালের ভোটে ২৮২ আসন জিতে কারও সাহায্য ছাড়াই তারা সরকার গড়ার অধিকারী হয়েছিল। এবারের ভোটে সেই সংখ্যা কমলেও একক বৃহত্তম দল হিসেবে তাদের টপকে যাওয়া অন্য কোনো দলের পক্ষে সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে ভোটের ফল বেরোনোর পর সরকার গড়ার প্রথম দাবিদার থাকবে তারাই। সেই সম্ভাবনা নষ্ট করার একমাত্র উপায় বিরোধীরা যদি ভোটের আগেই জোটবদ্ধ হয়। যদি অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি তৈরি করা যায়। ফল বেরোনোর পর সেই জোট বিজেপি কিংবা তার জোটের চেয়ে বেশি আসন পেলে রাষ্ট্রপতির পক্ষে তাদের দাবি উপেক্ষা করা কঠিন হবে। পাওয়ারের বাড়ির বৈঠকের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কোনোভাবেই বিজেপিকে সরকার গড়ার প্রথম দাবিদার হতে দেওয়া যাবে না।

প্রশ্ন হলো, নতুন সেই জোটে কারা কারা আসবে। গতকাল রাতের বৈঠকে সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টির নেতারা ছিলেন না। কেজরিওয়াল থাকলেও কংগ্রেসের সঙ্গে তারা দিল্লি, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের মোট ৩০টি লোকসভা কেন্দ্রে আসন ভাগাভাগি করবে কি না সন্দেহ। তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে লড়তে রাজি নয়। অরাজি কংগ্রেসও। রাজ্য কংগ্রেস আবার পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের সঙ্গে জোট বাঁধতে আগ্রহী হলেও কেন্দ্রীয় স্তরে কংগ্রেসের হাত ধরা সিপিএমের পক্ষে ভোটের আগে সম্ভব নয়। এই ধরনের বাধা, বিপত্তি ও বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও আঞ্চলিক বিজেপিবিরোধী নেতারা এই উপলব্ধি করছেন, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে জোটবদ্ধ হতে না পারলে বিজেপিকে রোখা কঠিন। দল বা জোট হিসেবে বিজেপি এক নম্বর দল হলে সরকার গড়ার প্রথম দাবিদার তারাই হবে। রাষ্ট্রপতিও তাদেরই প্রথম সুযোগ দেবেন।

তাগিদ কতটা বাস্তবায়িত হবে, দুই সপ্তাহের মধ্যেই তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। আপাতত এটুকু বলা যায়, শরদ পাওয়ারের বাড়িতে রাহুল গান্ধীর উপস্থিতি ও অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি তৈরির দায়িত্ব গ্রহণ সেই সম্ভাবনা উজ্জ্বল করে তুলেছে। আচমকা গৃহীত এই সিদ্ধান্তই বিরোধীদের মাস্টারস্ট্রোক।