এই পথ কি এতই সোজা?

সশস্ত্র তালেবান। ছবি: রয়টার্স
সশস্ত্র তালেবান। ছবি: রয়টার্স

একটি-দুটি বছর নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের লড়াই চলছে ১৭ বছর ধরে। তবু হারেনি তালেবান। তাদের দমন করতে গিয়ে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়নি মার্কিন সেনাবাহিনীর। অর্থও ঢালতে হয়েছে অঢেল। ব্যাপক জানমাল খুইয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন দম ফেলতে চায়। তারা ভাবছে, যুদ্ধের জের টানলে আরও খেসারত দিতে হতে পারে। এখন আলোচনায় যদি সমাধান আসে? কিন্তু এই পথ কি এতই সোজা?

সমঝোতার পথ খুঁজতে গত মাসের শেষ দিকে কাতারের রাজধানী দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের আলোচনা চলেছে ছয় দিন ধরে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ওয়াশিংটনের প্রধান মধ্যস্থতাকারী জালমে খালিলজাদ। যুক্তরাষ্ট্র, তালেবান জঙ্গি ও আফগান সরকারের মধ্যে শান্তিচুক্তির খসড়া কাঠামো ওই আলোচনায় তৈরি হয়েছে বলে জানান খালিলজাদ। ইকোনমিস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনে খালিলজাদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, সেখানে চারটি বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। প্রথমত, আফগানিস্তানে বিদেশি সন্ত্রাসীদের জায়গা দেবে না তালেবানরা। দ্বিতীয়ত, এর বিনিময়ে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেবে যুক্তরাষ্ট্র। তৃতীয়ত, তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে আলোচনা হবে। চতুর্থত, যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে হবে।

কিন্তু এখানে রয়েছে বেশ কিছু প্রশ্ন। যেগুলোর উত্তর মেলানো কঠিন। রয়েছে পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাবও। পেছন ফিরে দেখা যায়, নাইন–ইলেভেনের হামলার পরিকল্পনা আল–কায়েদার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেন নাকি আফগানিস্তানে বসেই করেছিলেন। লাদেনের খোঁজেই ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সেনা পাঠায়। লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানে ঘাপটি মেরে বসে থাকা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের খুঁজে বের করা। আরও একটি লক্ষ্যের কথা বলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেটি ছিল আফগানিস্তানে স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য কতটা পূরণ হয়েছে?

আফগানিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন সেনা। ছবি: রয়টার্স
আফগানিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন সেনা। ছবি: রয়টার্স



২০১৯ সালে এসেও আফগানিস্তানে তালেবানরা পরাস্ত হয়নি। আফগানিস্তানে আশরাফ ঘানির সরকারকেও মানে না তালেবানরা। তিনি শুধু তালেবান জঙ্গিদের কাছেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল সরকার হিসেবে চিহ্নিত। আফগানিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের ১ লাখ ৪০ হাজার সেনা তালেবান জঙ্গিদের পুরোপুরি পরাস্ত করতে পারেনি। প্রশ্ন হলো, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা সরে গেলে সে দেশের নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা তালেবানদের মুখোমুখি হতে পারবেন কি? তালেবানরা আফগান সরকারকে নাজুক পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে। তাই শান্তিপ্রক্রিয়া কার্যকর করতে তালেবানরা অস্ত্র পরিত্যাগে পুরোপুরি রাজি কি না, তা বুঝে নিতে হবে।

আবার তালেবানদের প্রধান দাবি মার্কিন সেনা প্রত্যাহার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার সেনা সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন। টেবিলে আলোচনা চলেছে অনেক। কিন্তু সেনা প্রত্যাহারের সুনির্দিষ্ট কোনো দিন বা সময়ের উল্লেখ করা হয়নি। তাই সেনা প্রত্যাহার আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।

ধরা যাক, সেনা প্রত্যাহার করা হলো। এরপর আফগানিস্তান কীভাবে চলবে? উত্তরটা সহজ। এ নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত আফগানদের মধ্যেই। কিন্তু আফগান সরকারের সঙ্গে তালেবানরা আলোচনায় কতটা আগ্রহী? ১৯৯০–এর দশকে যাদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছে, তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে কি তালেবানরা প্রস্তুত? সাধারণ আফগানরাও তালেবানদের সঙ্গে আলোচনা চায় কি?

আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। ছবি: রয়টার্স
আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। ছবি: রয়টার্স

জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক সংস্থার হিসাবে আফগানিস্তানে সাড়ে তিন কোটি মানুষ বাস করে। তার মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগের বেশি জনগোষ্ঠী তরুণ। তাদের বয়স ২৫ বছরের নিচে। অন্য যেকোনো দেশের তরুণদের মতো আফগানিস্তানের তরুণ প্রজন্মও প্রযুক্তির প্রসার চায়। আফগানিস্তানের দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে বেকারত্ব রয়েছে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে অনেকেই পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। অভিবাসী হিসেবে থাকছে বিভিন্ন দেশে। ২০১৪ সালের পর থেকে হাজার হাজার তরুণ অভিবাসী হিসেবে বাইরের দেশে পাড়ি দিয়েছে।

সম্প্রতি এএফপিতে প্রকাশিত আফগান তরুণ প্রজন্মবিষয়ক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, যারা আফগানিস্তানে আছে, তাদের মধ্যে অনেক তরুণ-তরুণীই এখন গান করে, স্কুলে যায়। তরুণ প্রজন্ম শৈশব থেকে এভাবেই বেড়ে উঠেছে। অনেক তরুণ মডেলিংয়ে যুক্ত। তাদের ভয়, তালেবানরা ক্ষমতায় এলে আবার অন্ধকার যুগে ফিরতে হবে না তো? কাবুলের মডেল সুলতান কাসিম সাইদি। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম থেকে ফ্যাশন আর মডেলিংয়ের নতুন নতুন শিক্ষা নেন তিনি। তালেবানরা ফিরে এলে মডেলিং আর চালাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে ভয় রয়েছে সাইদির। সাধারণ আফগানরা, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম তালেবান জঙ্গিদের ভয় পায়। তাদের চাওয়াকেও গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

তালেবানরা কী চায়, সেটাও ভেবে দেখা জরুরি। আফগান রাজনীতিবিদ নাদির নাইম আল–জাজিরায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলছেন, তালেবান জঙ্গিদের ক্ষোভও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। গত ১৭ বছরে অনেক তালেবান নেতা মার্কিন বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে। গুয়ানতানামো ও বাগরামে নির্যাতিত হয়েছে। এসব কারণে তালেবান অনেক সদস্য মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে চায়। তাদের দাবি আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশি সৈন্যের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং একটি সমন্বিত ইসলামিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা।

সাইদি ভাবেন, তালেবান ফিরলে তাঁর মডেলিংয়ের কী হবে? ছবি: রয়টার্স
সাইদি ভাবেন, তালেবান ফিরলে তাঁর মডেলিংয়ের কী হবে? ছবি: রয়টার্স



এ ছাড়া তালেবানের ছোটখাটো আরও কিছু দাবি রয়েছে। তারা চায়, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার তালিকা থেকে তাদের নেতাদের নাম প্রত্যাহার করা হোক। তাদের বন্দীদের মুক্ত করা হোক এবং দোহায় তাদের রাজনৈতিক কার্যালয়কে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। তালেবানরা আফগানিস্তানে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চায়।

যুদ্ধ ও সংঘাতের কারণে একসময়ের সুন্দর দেশ আফগানিস্তান এখন সবচেয়ে গরিব দেশে পরিণত হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের থিংক ট্যাংক গ্রিম স্মিথ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের মধ্যে শান্তি কাঠামো ঐতিহাসিক। এর বাস্তবায়ন কতটা হয়, তা সময়ই বলে দেবে।

শান্তি কাঠামো কার্যকর করতে এত সব হিসাব মেলানোর কাজ সহজ নয়; তবে অসম্ভবও নয়।