পোলিশ-অধ্যুষিত শহরে এখন আধিক্য বাংলাদেশিদের!

যুক্তরাষ্ট্রের হামট্রামিক শহরে প্রথমে পোলিশরা আবাস গড়তে শুরু করে। এরপর বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি আসতে শুরু করে বসনিয়ার অধিবাসীরা। গত কয়েক দশকে সেই জায়গা নিয়েছে ইয়েমেন ও বাংলাদেশের অভিবাসীরা। এক কথায় এটি হলো অভিবাসীদের শহর। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের হামট্রামিক শহরে প্রথমে পোলিশরা আবাস গড়তে শুরু করে। এরপর বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি আসতে শুরু করে বসনিয়ার অধিবাসীরা। গত কয়েক দশকে সেই জায়গা নিয়েছে ইয়েমেন ও বাংলাদেশের অভিবাসীরা। এক কথায় এটি হলো অভিবাসীদের শহর। ছবি: সংগৃহীত

শহরটির নাম হামট্রামিক। গত শতকে এই শহরে পোলিশরা আবাস গড়তে শুরু করে। এরপর বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি আসতে শুরু করে বসনিয়ার অধিবাসীরা। গত কয়েক দশকে সেই জায়গা নিয়েছেন ইয়েমেন ও বাংলাদেশের অভিবাসীরা। এক কথায় এটি হলো অভিবাসীদের শহর। যেখানে আগে পোলিশদের আধিপত্য ছিল, সেখানে এখন সড়কের নাম হয়েছে ‘বাংলাদেশ অ্যাভিনিউ’। ধীরে ধীরে পোল্যান্ডের অভিবাসীদের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশি ও ইয়েমেনিরা।

‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্যের শহর হামট্রামিকের এই রূপান্তর এখন বেশ চোখে পড়ে। শহরটির বিভিন্ন রাস্তায় দোকানের সাইনবোর্ডে দেখা যায় বাংলা ও আরবি হরফ। শহরের একটি প্রধান সড়কের নামকরণই হয়েছে ‘বাংলাদেশ অ্যাভিনিউ’। ২০১৫ সালের নির্বাচনের পর হামট্রামিকের সিটি কাউন্সিলে প্রথমবারের মতো মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পান। পুরো মার্কিন মুলুকেই এমন ঘটনা প্রথম। ওই ঘটনায় গণমাধ্যমেও বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। যেসব সাবেক অধিবাসীরা এরই মধ্যে শহর ছেড়ে গেছেন, তাঁরা ওই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনায় সরব হয়ে উঠেছিলেন।

এর একটি প্রধান কারণ হলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা। পোলিশ (পোল্যান্ডের অধিবাসী) অভিবাসীরা বাংলাদেশি ও ইয়েমেনিদের আধিক্য মেনে নিতে পারেননি। কেউ কেউ তো শহর ছেড়ে চলেও গিয়েছেন। আর এই চলে যাওয়াতেই শহরটির জনমিতি বদলে গেছে পুরোপুরি। জনমিতি বদলে যাওয়ার কাজটি হয়েছে গত তিন দশকে। ২০১৭ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে শহরের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭ শতাংশ হলো পোল্যান্ড বংশোদ্ভূত। অবশ্য হামট্রামিকে এখনো পোলিশ ঐতিহ্যের ছোঁয়া পাওয়া যায়। স্থানীয় পোলিশ আর্ট সেন্টারে এখনো দর্শনার্থীদের বেজায় ভিড় লক্ষ করা যায়।

‘নিউইয়র্ক টাইমস’ বলছে, ২০০৪ সালে হামট্রামিকে প্রথম মসজিদ থেকে মাইকে আজান দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ডেমোক্রেটিক পার্টি সেই অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল। এখন শহরের রাস্তায় হিজাব পরিহিত নারীদের আনাগোনাও বেশি, বোরকাও দেখা যায় হরহামেশা। স্থানীয় লোকজন বলছেন, এই শহরের মুসলিম অভিবাসীরা বাংলাদেশ ও ইয়েমেনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছেন।

খুব স্বাভাবিকভাবেই অভিবাসী অধ্যুষিত হামট্রামিক শহরে অনেক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়া ঘটেছে এবং এখনো ঘটছে। মাঝেমধ্যে এর মধ্যে সংঘাতও হয়।

কিন্তু একসঙ্গে থাকতে গেলে কিছু ছোটখাটো সমস্যা তো হবেই। বর্তমানে হামট্রামিকের মেয়র হলেন কারেন মায়াভস্কি। তিনি একজন পোলিশ-আমেরিকান। কারেন বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি কেউ যদি সইতে না পারে, তবে তারা চলে যেতেই পারে। মানুষ মাঝেমধ্যে অভিযোগ করে এটি সত্যি। কিন্তু একই সঙ্গে তারা এ-ও বলে, প্রতিবেশীদের নিয়েই তারা থাকতে চায়। তাই আমি অভিযোগের বিষয়ে উদ্বিগ্ন নই।’

শহরের অনেক পুরোনো অধিবাসী গ্রেগ কোভালস্কি। ৬৮ বছর বয়সী এই পোলিশ-আমেরিকান এখনো হামট্রামিকেই আছেন। সেখানে একটি জাদুঘর চালান তিনি। গ্রেগ মনে করেন, বৈচিত্র্যই এই শহরের মূল সম্পদ। তিনি বলেন, ‘এখানে জীবনের এক বিস্ময়কর প্রদর্শনী মঞ্চস্থ হয়।’

তবে মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাবে মাঝেমধ্যে কি মন খারাপ হয় না ইয়েমেনি ও বাংলাদেশিদের? হয়। ৩৬ বছর বয়সী বাংলাদেশি অভিবাসী নাজ হুদা বলেন, ‘একটি বিষয় আমাকে খুব আহত করে। অনেক সময় মানুষ এই শহরকে “সন্ত্রাসীদের শহর” বলে অভিহিত করে থাকে। কেউ কেউ বলে, এই শহর নাকি মুসলমানেরা চালায়। আমি এ ধরনের কথাকে ঘৃণা করি। যাদের সম্পর্কে বলা হয়, তারা আমেরিকান। তারা নির্বাচনে জিতেই এসেছে।’

হামট্রামিকে অনেক সমস্যাও আছে। এর মোট জনসংখ্যা ২২ হাজার। এর অর্ধেকেই দরিদ্র। অন্তত সরকারি জরিপ তা-ই বলছে। শহরটির পৌরসভার তহবিলের অবস্থাও তথৈবচ। কাছাকাছি থাকা জেনারেল মোটরসের কারখানাটিও নাকি আগামী জানুয়ারিতেই বন্ধ হয়ে যাবে! এক অর্থে, হামট্রামিকের অর্থনৈতিক অবস্থাকে কোনো দিক থেকেই ভালো বলার জো নেই।

তবে এত সমস্যাকে সঙ্গে নিয়েই আশার আলো দেখেন শহরটির অধিবাসীরা। আশার প্রদীপটি জ্বালিয়ে রেখেছে শহরের অধিবাসীদের যূথবদ্ধতা। এই শহরের অভিবাসী আমেরিকানরা যে একসঙ্গে পথ হাঁটার অভ্যাস গড়ে ফেলেছেন! তাই কোনো সমস্যাকেই আর বড় করে দেখতে চান না তাঁরা। শহরের মেয়র কারেন মায়াভস্কি বলেন, ‘হামট্রামিকের পরিচয় গত ১০০ বছরেও পরিবর্তন হতে দেখিনি। আমরা একটি অভিবাসী শহরের বাসিন্দা। আমি মনে করি না বিষয়টির কোনো পরিবর্তন হবে। পরিবর্তন আসবে শুধু অভিবাসীর সংখ্যায়।’