হোক ওরা জঙ্গি, ওদের শিশুদের বাঁচান

সিরিয়ার আল-হোল শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেওয়া এক শিশু। ছবি: রয়টার্স
সিরিয়ার আল-হোল শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেওয়া এক শিশু। ছবি: রয়টার্স

বিনা দোষে অপরাধের সাজা নির্মমভাবে ভোগ করতে হচ্ছে তাদেরও। মা-বাবার ভুল সিদ্ধান্তে, মা-বাবার দোষে বলি হতে হচ্ছে। পৃথিবীতে এসেই নিষ্ঠুরতা দেখতে হচ্ছে তাদের। ন্যূনতম সহানুভূতিও যেন জোটে না। কাউকে ন্যূনতম নাগরিক অধিকারবঞ্চিত হয়ে প্রতিকূলতার মধ্যে জীবন শুরু করতে হচ্ছে। কেউ কেউ প্রতিকূলতার মুখে টিকতে না পেরে বিদায় নিচ্ছে পৃথিবী থেকে। আইএস–বধূ শামীমা বেগমের সন্তানকে যেভাবে বিদায় নিতে হয়েছে। মা-বাবা জঙ্গি হলেও এই শিশুদের বাঁচানোর আহ্বান জানিয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ভারতের কৈলাস সত্যার্থী।

আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএসে যোগ দেওয়া নারীদের সন্তানদের বাঁচাতে ইউরোপীয় সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নোবেলজয়ী কৈলাস সত্যার্থী। ব্রিটিশ নাগরিক আইএস–বধূ শামীমা বেগমের সন্তানের মৃত্যুর পর এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি যেসব দেশের নাগরিকেরা আইএসে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের নিজ নিজ নাগরিকের সন্তানদের সুরক্ষা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

গত বৃহস্পতিবার সিরিয়ার একটি শরণার্থীশিবিরে শামীমা বেগমের ২০ দিন বয়সী নবজাতক ছেলের মৃত্যু হয়। সন্তান জন্ম নেওয়ার চার-পাঁচ দিন পর শামীমার নাগরিকত্ব বাতিল করেন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ নাভিদ। শামীমার সন্তানের মৃত্যুর ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠন ও বামপন্থী বিরোধী দলগুলোর কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে ব্রিটিশ সরকার। ২০১৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে আইএসে যোগ দিতে যুক্তরাজ্য ছাড়েন শামীমা। পরে আইএসের এক সদস্য ডাচ্‌ তরুণকে বিয়ে করেন। আত্মসমর্পণের পর তাঁর স্বামী এখন কুর্দি বাহিনীর হাতে বন্দী।

২০১৪ সালে পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাইয়ের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান ভারতের শিশু অধিকার নিয়ে কর্মরত কৈলাস সত্যার্থী। শামীমার সন্তানের মৃত্যুর পর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এই শিশুরা তো জিহাদি নয়। আমরা যদি তাদের যথাযথ যত্ন ও সুরক্ষা না দিই এবং মানুষ হিসেবে ভালোবাসা, সম্মান ও স্বীকৃতি না দিই, তাহলে এই শিশুদের তাদের (জঙ্গিদের) নিজেদের কাজে অপব্যবহারের আরও সুযোগ থেকে যায়। এর চেয়ে ভালো তাদের (আইএস শিশু) আলিঙ্গন করা।’

সিরিয়ার আল-হোল শরণার্থীশিবির। ছবি: রয়টার্স
সিরিয়ার আল-হোল শরণার্থীশিবির। ছবি: রয়টার্স

সিরিয়ায় আইএস পরাজিত হওয়া শুরু করলে তাদের হাজার হাজার নারী ও শিশু বাঘুজে থেকে স্রোতের মতো পালাতে থাকে। বাঘুজে ছিল সিরিয়ায় আইএসের সবশেষ শক্ত ঘাঁটি। কুর্দি নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনী সেখানে ব্যাপক হারে হামলা চালায়।

পালিয়ে আসা আইএসের নারী ও শিশুরা তাদের নিজ নিজ দেশগুলোর চরম উদাসীনতার মুখে পড়ে। জিহাদি ও আইএসের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা এবং তাদের সন্তানদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে উদাসীনতা দেখায় দেশগুলো।

জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে, সিরিয়ার আল-হোল শরণার্থীশিবিরে ৪৩টি দেশের তিন হাজার বিদেশি শিশু আছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই আইএসের পতনের পর গত কয়েক সপ্তাহে শরণার্থীশিবিরে এসেছে।

কৈলাস সত্যার্থী বলেন, হয়তো এই শিশুরা জিহাদি বা আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী বা জঙ্গির সন্তান। তারা সেই সব পরিবারে জন্ম নিয়েছে, এটা তো তাদের কোনো দোষ না।

কিছু দেশ, বিশেষ করে রাশিয়া আইএসে যোগ দেওয়া তাদের নাগরিকদের সন্তানদের পুনর্বাসন করেছে। তাদের পরিবারের সদস্য বা অন্য কোনো বাবা-মায়ের (ফস্টার প্যারেন্ট) কাছে তুলে দিয়েছে। তবে ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও ব্রিটেন ওই শিশুদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে একেবারেই নারাজ।

নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ভারতের কৈলাস সত্যার্থী। ছবি: এএফপি
নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ভারতের কৈলাস সত্যার্থী। ছবি: এএফপি

ফরাসি জিহাদিদের পরিবারের পক্ষে কর্মরত মারি দোজ নামের এক আইনজীবী অভিযোগ করেন, ফ্রান্স সরকারের মনোভাব হচ্ছে, ‘ওদের মরতে দাও’।

কৈলাস সত্যার্থীর নিজের সংগঠনের নাম ‘বাচপান বাঁচাও আন্দোলন’। শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কাজ করে সংগঠনটি। এ ব্যাপারে কৈলাস সত্যার্থী বলেন, শিশুশ্রম রোধে অগ্রগতি হলেও এখনো অনেক কিছু করা বাকি। ভারত সরকার বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শিশুদের বিষয়টিকে এখনো অগ্রাধিকার দেয় না। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের অনেক জায়গায় শিক্ষকের চেয়ে সেনা বেশি, শিশুদের জন্য বই ও খেলনার চেয়ে অস্ত্র বেশি।’

শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি কৈলাস সত্যার্থী এখন অনলাইনে শিশু পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। তাঁর মতে, এটা শিশুদের জন্য ভয়াবহ হুমকি। শিশুদের এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রাপ্তবয়স্কদের পর্নোগ্রাফি শিশুদের দেখার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নতুন কনভেনশনের পক্ষে সমর্থন বাড়াতে তিনি বিভিন্ন দেশ সফর করছেন। তিনি বলেন, এটা ইন্টারনেটের একটি ভয়ংকর দিক। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। কঠোর আন্তর্জাতিক আইন ছাড়া এটা বন্ধ করা সম্ভব নয়।