রক্তে ভাসল নিউজিল্যান্ডের শহর

‘গুলি যখন শুরু হলো, প্রথমে কেউ কিছু বুঝতেই পারছিল না। চিৎকার-চেঁচামেচি আর গুলির শব্দ মিলেমিশে একাকার। তারপর একনাগাড়ে গুলির আওয়াজ। লোকজনের ছোটাছুটি, পড়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। জানালা ভেঙে বাইরে লাফিয়ে পড়লেন কয়েকজন। এটাই ছিল বাঁচার একমাত্র পথ। আমিও তাঁদের অনুসরণ করলাম।’

 নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদে বন্দুকধারীর হামলার বর্ণনা এভাবেই দিলেন সেখানকার বাসিন্দা নুর তাভিস। ওই মসজিদ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের লিনউড মসজিদে হামলা হয় কয়েক মিনিটের ব্যবধানে।

দুই মসজিদে এ হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৪৯ জন, আহত ৪৮। নিহত তিনজন বাংলাদেশি। এ ছাড়া চার বাংলাদেশি আহত এবং একজন নিখোঁজ আছেন। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সদস্যরা। আল নুর মসজিদের পাশে ক্রাইস্টচার্চ ওভাল মাঠে অনুশীলন এবং সংবাদ সম্মেলন শেষে মসজিদে জুমার নামাজ আদায়ের জন্য বেরিয়েছিলেন ক্রিকেটাররা।

আল নুর মসজিদে হামলা হয় স্থানীয় সময় বেলা ১টা ৪০ মিনিটের দিকে। এর পাঁচ–ছয় মিনিট পর হামলা হয় লিনউড মসজিদে। গুগল ম্যাপের তথ্য অনুসারে, সড়কপথে এ দুই মসজিদের দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার।

বন্দুকধারীর হামলায় নিহত ৪৯ জনের মধ্যে আল নুর মসজিদে প্রাণ গেছে ৪১ জনের। সাতজন নিহত হয়েছেন লিনউড মসজিদে। পরে হাসপাতালে মারা যান একজন। হতাহতদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। দুই মসজিদে একই বন্দুকধারী হামলা চালিয়েছেন কি না, তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। আল নুর মসজিদে হামলাকারী ব্যক্তির সম্প্রচারিত ভিডিওতে দেখা যায়, হামলার একপর্যায়ে তিনি একটি গাড়ির পেছন থেকে আগ্নেয়াস্ত্র পরিবর্তন ও ব্যাগে থাকা ম্যাগাজিন নিচ্ছেন। তবে লিনউড মসজিদের ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, সেখানে কালো মোটরসাইকেলে করে হেলমেট পরা এক বন্দুকধারী হামলা চালান। তাঁর পরনে ছিল বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট।

ক্রাইস্টচার্চে হামলার ঘটনায় ব্রেনটন টারান্ট (২৮) নামের এক যুবক এবং এক নারীসহ চারজন আটক হয়েছেন। কয়েকটি বিস্ফোরক ধ্বংস করেছে নিউজিল্যান্ডের পুলিশ। পরে অবশ্য একজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ব্রেনটনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিউজিল্যান্ডে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করা হয়েছে। দেশটির সব মসজিদের দরজা বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে সব মসজিদের সামনে সশস্ত্র পাহারাও বসানো হয়েছে।

হামলার কিছু আগে এইটচ্যান নামে একটি ওয়েবসাইটে অজ্ঞাত এক ব্যবহারকারী একটি পোস্ট দেন। তিনি এতে লেখেন, পোস্টের লেখক ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ ওপর হামলা চালাতে যাচ্ছেন। হামলার সময় সরাসরি সম্প্রচারিত ভিডিওর শুরুতে তিনি অভিবাসীদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দেন। একই সঙ্গে একটি ইশতেহারও প্রকাশ করেন। ইশতেহারে তিনি দাবি করেন, তিনি ২০১১ সালে নরওয়েতে হামলা চালিয়ে ৭৭ জনকে হত্যা করা অ্যান্ডার্স ব্রেহরিং ব্রেইভিকের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে হামলা চালিয়েছেন। হামলার আগে টুইটারে পোস্ট করা এক ইশতেহারে তিনি এ দাবি করেন। ২০১১ সালের ২২ জুলাই অসলোয় ভ্যানবোমা বিস্ফোরণ এবং এরপর উটোয়া দ্বীপে লেবার পার্টির যুবদলের সভায় গুলি চালান তিনি। ব্রেইভিক দাবি করেছিলেন, বহুত্ববাদ অবলম্বনকারীদের ওপর তিনি ওই হামলা চালিয়েছিলেন।

আল–জাজিরা জানায়, আল নুর মসজিদে হামলার ভিডিওতে দেখা যায়, হামলা শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে এক মুসল্লি বন্দুকধারীকে ‘হ্যালো ব্রাদার’ বলে সম্বোধন করেন। এর পরপরই বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন তিনি।

নিউজিল্যান্ডের সংবাদপত্র ‘নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড’-এর অনলাইন সংস্করণের এক খবরে বলা হয়, লিনউড মসজিদে হামলায় বেঁচে যাওয়া সৈয়দ মাজহারুদ্দিন নামের একজন বলেছেন, হামলাকারী গুলি শুরু করলে মসজিদের ভেতর থেকে এক তরুণ এগিয়ে গিয়ে ওই হামলাকারীকে ঘুষি মারেন এবং বন্দুক কেড়ে নেন। এরপর বন্দুকধারী পালিয়ে যান।

 গুলির ঘটনার পর হতাহতদের পরিবারের সদস্যরা ক্রাইস্টচার্চ হাসপাতালে ভিড় করেন। গত রাতটা তাঁদের কেটেছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে।

সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেছেন, হামলাকারী ব্রেনটন অস্ট্রেলিয়ার বংশোদ্ভূত। তিনি চরমপন্থী, ডানপন্থী ও একজন সহিংস সন্ত্রাসী।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হামলায় নিহতদের মধ্যে দুজন ভারতীয় রয়েছেন। এ ছাড়া এ ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন দেশটির ৯ জন নাগরিক। নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকায় আফগানিস্তানসহ আরও কয়েকটি দেশের নাগরিকও রয়েছেন।

নিউজিল্যান্ডের কালোতম দিন
ক্রাইস্টচার্চের এ হামলার ঘটনাকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ আখ্যা দিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আহডার্ন। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের দেশ বৈচিত্র্য, মহানুভবতা, সহানুভূতির ধারক এবং যাঁরাই আমাদের মূল্যবোধে বিশ্বাসী, তাঁদের আশ্রয়স্থল বলেই আমরা এ হামলার শিকার হয়েছি।’ তিনি হামলার দিনটিকে নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে কালোতম দিন হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

বিশ্বজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার
ক্রাইস্টচার্চে হামলার ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় শহরগুলোয় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। বিশেষ করে মসজিদ প্রাঙ্গণগুলোয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করা হয়। এদিকে যুক্তরাজ্যের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, পোপ ফ্রান্সিসসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং ধর্মীয় নেতারা এ হামলার ঘটনায় ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছেন।

নিউজিল্যান্ডে গুলির ঘটনা বিরলই বলা চলে। ১৯৯২ সালে দেশটিতে ‘বন্দুক আইন’ আগের তুলনায় কঠোর করা হয়। এর দুই বছর আগে সাউথ আইল্যান্ডের আরামোয়ানা শহরে মানসিক বিকারগ্রস্ত এক ব্যক্তির গুলিতে ১৩ জন নিহত হন। এরপরও দেশটির বন্দুক আইন যথেষ্ট শিথিল রয়েছে। নিউজিল্যান্ডে ১৬ বছরের বেশি বয়সী যে কেউ নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের নিবন্ধন পেতে পারে।