সংকটে সুযোগ দেখছেন থেরেসা মে

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করতে গিয়ে গলদঘর্ম যুক্তরাজ্য। দেশের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কৌশল নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো অনৈক্য আর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত। সরকারের মন্ত্রিসভায়ও ব্রেক্সিটের কৌশল নিয়ে মতবিরোধ স্পষ্ট।

এমন অনৈক্যের ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। সংসদে ব্রেক্সিট চুক্তি পাস করাতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। অন্যদিকে চুক্তি ছাড়া বিচ্ছেদ কার্যকরের জন্যও সমর্থন পাননি। ফলে গত আড়াই বছর ধরে চলা ব্রেক্সিট কার্যকরের সব চেষ্টাই এখন পর্যন্ত ফল শূন্য। তাই ২৯ মার্চ ব্রেক্সিট কার্যকর হবে বলে যে দিনক্ষণ নির্ধারিত রয়েছে, শেষ সময়ে এসে তা পিছিয়ে দেওয়ার আলোচনা শোনা যাচ্ছে জোরেশোরে।

ইউরোপের ২৮টি দেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সদস্যভুক্ত দেশগুলো নিজেদের মধ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করে। নাগরিকেরা সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে অবাধে চলাচল করতে পারে এবং পূর্ণ নাগরিক অধিকার ভোগ করে। দেশগুলো কৃষি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, নাগরিক অধিকার এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণাসহ অনেক কিছুতে একক নিয়ম মেনে চলে। ১৯৭৩ সাল থেকে যুক্তরাজ্য এই জোটের সদস্য।

কোনো দেশ চাইলে এই জোট ছেড়ে যেতে পারে। লিসবন চুক্তির ৫০ অনুচ্ছেদে জোট ত্যাগের উপায় বলা আছে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জোট ত্যাগের আনুষ্ঠানিক আবেদন জানানোর পর থেকে দুই বছর পূর্ণ হওয়ার দিনে সম্পর্কের অবসান ঘটবে।

সংশ্লিষ্ট দেশ চাইলে সমঝোতার মাধ্যমে সম্পর্ক গুটিয়ে নিতে পারে। অথবা চুক্তি ছাড়াই সম্পর্কের অবসান হবে। ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ যুক্তরাজ্য বিচ্ছেদের আনুষ্ঠানিক আবেদন জানায়। ২৯ মার্চ সেই আবেদনের দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে। ইইউর ইতিহাসে যুক্তরাজ্য প্রথম কোনো দেশ যারা এই জোট ছাড়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

চুক্তি ছাড়া সম্পর্কের অবসান যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে ধস নামাবে বলে আশঙ্কা। এটি ইইউর জন্যও ক্ষতিকর। তাই ক্ষতির পরিমাণ কমাতে দীর্ঘ দুই বছর ধরে উভয় পক্ষ একটি চুক্তি সম্পাদনে চেষ্টা চালাচ্ছে।

গত নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী মে ইইউর সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছান। ১৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে যুক্তরাজ্যের সংসদ ২৩০ ভোটের ব্যবধানে সেই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। চুক্তিতে উল্লেখিত বিচ্ছেদ–পরবর্তী আয়ারল্যান্ড সীমান্ত ব্যবস্থাপনা নিয়ে অধিকাংশ আইনপ্রণেতার আপত্তি।

ইইউ জোটের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের একমাত্র স্থলসীমা আয়ারল্যান্ড সীমান্ত। ১৯৯৮ সালে সম্পাদিত এক দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে স্বাধীন আয়ারল্যান্ড এবং নর্দান আয়ারল্যান্ডের মধ্যকার সীমান্তে কোনো তল্লাশিচৌকি না বসানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যুক্তরাজ্য। এই প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য ব্রেক্সিট চুক্তিতে বলা হয়েছে, আয়ারল্যান্ড সীমান্ত উন্মুক্ত রাখার বিকল্প কোনো উপায় না পাওয়া গেলে যুক্তরাজ্যের অংশ নর্দান আয়ারল্যান্ড ইইউ আইনের অধীনে থাকবে। এটিকে বলা হচ্ছে ‘বেকস্টপ’ ব্যবস্থা। ‘বেকস্টপ’ ব্যবস্থার বিরোধী ব্রিটিশ আইনপ্রণেতারা বলছেন, এটি নর্দান আয়ারল্যান্ডকে যুক্তরাজ্যের বাকি অংশ থেকে আইনিভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে।

নর্দান আয়ারল্যান্ডের আঞ্চলিক দল ডেমোক্রেটিকস ইউনিয়নিস্ট (ডিইউপি) পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকারে আছে কনজারভেটিভ দল। ডিইউপি বেকস্টপ ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী। একইভাবে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের কট্টর ব্রেক্সিটপন্থীরাও এই বেকস্টপ ব্যবস্থার বিরোধী।

বেকস্টপ ব্যবস্থা চিরস্থায়ী হবে না, এমন প্রতিশ্রুতি আদায় করে ১২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী মে চুক্তিটি আবারও সংসদে তোলেন। কিন্তু তা সমালোচকদের কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি। এদিন ১৪৯ ভোটের ব্যবধানে চুক্তিটি প্রত্যাখ্যাত হয়। কনজারভেটিভ দলের ৭৫ জন এবং ডিইউপির ১০ জন সাংসদ চুক্তির বিপক্ষে ভোট দেন।

এরপর গত বুধবার এক প্রস্তাব পাসের মাধ্যমে আইনপ্রণেতারা জানিয়ে দেন কোনো অবস্থাতেই তাঁরা চুক্তি ছাড়া বিচ্ছেদ চান না। পরদিন বৃহস্পতিবার আরেক ভোটাভুটিতে বিচ্ছেদের সময় পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে রায় দেন আইনপ্রণেতারা। এসব ভোট ছিল কেবল মতামত যাচাইয়ের জন্য, যার ফলাফল মানতে বাধ্য নয় সরকার। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সংসদের এসব মতামত উপেক্ষা করা প্রধানমন্ত্রীর জন্য প্রায় অসম্ভব।

প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বলেছেন, বিচ্ছেদের সময় পিছিয়ে দেওয়ার আবেদন জানানোর আগে তিনি ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে আবারও সংসদে ভোটাভুটির আয়োজন করবেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ব্রেক্সিটের ভবিষ্যৎ নিয়ে সৃষ্ট সংকটের মধ্যে সুযোগের সম্ভাবনা দেখছেন প্রধানমন্ত্রী মে। সে কারণেই দুই দফা প্রত্যাখ্যাত হওয়া চুক্তি নিয়ে আবারও ভোট চাইছেন। কেননা, চুক্তিটি আবারও প্রত্যাখ্যাত হলে বিচ্ছেদ দীর্ঘ সময়ের জন্য পিছিয়ে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে পুনরায় গণভোট কিংবা মধ্যবর্তী নির্বাচনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে এবং ব্রেক্সিটের সিদ্ধান্ত বাতিল হওয়ার মতো ঝুঁকি বাড়বে। চুক্তির সমালোচক ব্রেক্সিটপন্থীরা ওই পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া এড়াতে এবার মের চুক্তিতে সমর্থন দেবেন বলে ধারণা।

২১ থেকে ২৩ মার্চ ইইউ সম্মেলন। এর আগেই চুক্তি অনুমোদন প্রশ্নে তৃতীয় ভোটাভুটির আয়োজন করতে চান প্রধানমন্ত্রী। চুক্তির বিরোধী ব্রেক্সিটপন্থী আইনপ্রণেতারা ইতিমধ্যে তাঁদের সুর নরম করেছেন। তাঁরা চুক্তিতে সমর্থন দেওয়ার উপায় খুঁজতে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, চুক্তিতে সমর্থন দেওয়ার বিনিময়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে মের পদত্যাগ চান। যাতে ব্রেক্সিটপন্থী কোনো প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ধারণের আলোচনায় নেতৃত্ব দিতে পারেন।

তবে বিচ্ছেদের সময় যে পিছিয়ে যাবে, সেটি এখন অনেকটা নিশ্চিত। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, ব্রেক্সিট চুক্তি পাস হলে ৩০ জুন পর্যন্ত বিচ্ছেদ পেছানোর প্রয়োজন হতে পারে। আনুষঙ্গিক আইন পাস করিয়ে নেওয়ার জন্য এ বাড়তি সময়ের প্রয়োজন পড়বে। আর চুক্তিটি পাস না হলে নতুন করে সমঝোতার প্রয়োজন হবে। সে ক্ষেত্রে বিচ্ছেদ অন্তত ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে দিতে হবে বলে আলোচনা আছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, আগামী মে মাসের মধ্যে সম্পর্ক গুটিয়ে না নিলে ওই মাসে অনুষ্ঠেয় ইইউ নির্বাচনে যুক্তরাজ্যকে অংশ নিতে হবে। ব্রেক্সিট নিয়ে নতুন করে ভাবতে চাইলে ইইউ বিচ্ছেদের সময় বাড়াতে রাজি।

কিন্তু সময় বাড়ালেই যে ব্রিটিশ আইনপ্রণেতারা ব্রেক্সিট নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে পারবেন, সেটি হলফ করে কেউ বলতে পারছেন না।

২০১৬ সালের ২৩ জুন অনুষ্ঠিত এক গণভোটে যুক্তরাজ্যের মানুষ ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় দেয়। মাত্র ৪ শতাংশের ব্যবধানে (৫২ বনাম ৪৮ শতাংশ) বিচ্ছেদপন্থীদের জয় হয়। শীর্ষ রাজনৈতিক মহলে অপ্রত্যাশিত সেই রায় যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে বিভক্তির বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়। গণভোটে ইইউতে থাকার পক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। ফলে জনগণের দেওয়া বিচ্ছেদের রায় মেনে তিনি পদত্যাগ করেন। গণভোটের রায় কার্যকরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন থেরেসা মে। কিন্তু শুরু থেকেই বিচ্ছেদ কার্যকরের কৌশল নিয়ে নিজ দলেই হোঁচট খাচ্ছেন তিনি। ব্রেক্সিট নিয়ে মতবিরোধকে কেন্দ্র করে তাঁর মন্ত্রিসভা থেকে গত দেড় বছরে ৯ জনের পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। সব বাধা উপেক্ষা করে অনেকটা এককভাবে ব্রেক্সিট সমঝোতা চালিয়ে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মে।

বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রী মের সম্পাদিত চুক্তির সমালোচনা করলেও এর বিকল্প উপস্থাপনে ব্যর্থ। লেবার পার্টি ব্রেক্সিটের যে বিকল্প প্রস্তাব দিয়ে আসছে, সেটি সংসদে একাধিকবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।