বাড়িপালানো সৌদি দুই বোন এখন নতুন দেশে

দুই বোনের নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের আসল পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। ছবি: রয়টার্স
দুই বোনের নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের আসল পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

বাড়ি থেকে পালানো সৌদি আরবের সেই দুই বোনের ‘দেশহীন’ জীবনের ইতি ঘটেছে। তৃতীয় একটি দেশে বসবাসের অনুমতি পেয়েছেন তাঁরা। এই জীবন নিয়ে এখন পর্যন্ত দারুণ খুশি তাঁরা।

সৌদি আরবে নিজ পরিবার বিশেষ করে বাবা ও ভাইয়ের কঠোর অনুশাসনে একধরনের বন্দিজীবন থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিলেন তাঁরা। পরিবারের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলেন তাঁরা। সেখান থেকে পালিয়ে হংকং পৌঁছান দুই বোন। হংকং থেকে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু হংকংয়ে তাঁদের বাধা দেন সৌদি কূটনৈতিক কর্মকর্তারা। গত নভেম্বরে তাঁদের পাসপোর্ট বাতিল করে সৌদি কর্তৃপক্ষ। তারপর থেকে তাঁদের শুরু হয় ‘রাষ্ট্রহীন’ আতঙ্কের জীবন।

দুই বোন এখন দিন গুনছেন একটি ‘উজ্জ্বল, সুন্দর ভবিষ্যতের’। রয়টার্স বলছে, ইতিমধ্যে তৃতীয় একটি দেশে আশ্রয় মিলেছে দুই বোনের। হংকং থেকে ইতিমধ্যেই সেই দেশে পৌঁছে গেছেন তাঁরা। নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় ওই দেশের নাম উল্লেখ করা হয়নি। দুই বোনের ছবিও প্রকাশ করা হয়নি।

কোকড়ানো চুলের ছোট বোনটি রয়টার্সকে বলেন, ‘একটি দেশ আমাদের আশ্রয় দিচ্ছে—সংবাদটি শুনে আমি খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠেছিলাম, এটা আসলেই সত্য হতে চলেছে।’

পাসপোর্ট বাতিল হওয়ার পরে হংকংয়ের অভিবাসন কর্তৃপক্ষ দুই বোনকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছিল। এরপর তাঁদের হংকং থেকে বের করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল হংকং কর্তৃপক্ষের কাছে দুই বোনকে বের না করে দেওয়ার অনুরোধ জানায়।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সঙ্গে হংকংয়ের একটি হোটেলে কথা হয় দুই বোনের। এরপরই তাঁরা শহর ছেড়ে চলে যান। ওই সাক্ষাতের সময় সেখানে হংকংভিত্তিক মানবাধিকার আইনজীবী মাইকেল ভিলার যোগ দেন। ভিলার তাঁদের আবাসন পেতেও সাহায্য করেছেন।

দুই বোন জানান, গত ছয় মাস আতঙ্কে ছিলেন। তাই বারবার থাকার জায়গা বদল করছেন। অন্তত ১৫টা বাড়িতে থেকেছেন।


আইনজীবী ভিলার তাঁর ফেসবুকে জানান, দুই বোন ‘মানবিক ভিসায়’ সফলভাবে একটি দেশে পৌঁছেছেন। নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় ওই দেশের নাম প্রকাশ করা হবে না। প্রকাশ করা হবে না আর কোনো তথ্য। এমনকি ওই দুই বোনও আর কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারও দেবেন না।

এই দুই বোনের বিষয় নিয়ে রয়টার্সের পক্ষ থেকে হংকংয়ের সৌদি কনস্যুলেটের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা কোনো মন্তব্য করতে চায়নি।

দুই বোন রয়টার্সকে বলেন, তাঁরা ভয়ে ছিলেন, সৌদি কনস্যুলেট তাঁদের ধরে সৌদি আরবে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। তাঁরা অভিযোগ করেন, সৌদিতে নিজ বাড়িতে তাঁদের শারীরিকভাবে আঘাত করা হতো। এতে তাঁদের বাবার সঙ্গে ১০ বছর বয়সী ছোট ভাইও যোগ দিত। ছোট ভাই হলেও বোনদের প্রতি তার আচরণ ছিল বড় ভাইয়ের মতো। তাঁরা বলেন, ‘তাঁদের আচরণে মনে হতো আমরা কয়েদি, আরা তাঁরা কয়েদখানার কর্মকর্তা।’

সৌদি নারীদের কাজ, ভ্রমণ, বিয়ে বা চিকিৎসা নিতে হলে সব সময় একজন পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নিতে হয়। এই ব্যবস্থার সমালোচনা করেন দুই বোন। লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখা বড় বোনটি জানান, ‘সৌদিতে নারীকে ক্রীতদাসের মতো দেখা হয়। আমি সেখান থেকে বের হতে চেয়েছি এবং নিরাপদ থাকতে চেয়েছি। এ নিয়ে আমাদের কোনো অনুশোচনা নেই।’

তুরস্কে সৌদি কনস্যুলেটে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যার খবর দেখার পর থেকে দুই বোন হংকংয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। বড় বোন (২০) বলেন, ‘আমার বোনকে বলেছি, আমি গর্বিত পালিয়ে আসার জন্য। এমন একটি দেশ থেকে পালিয়েছি, যার জন্য কোনো অনুশোচনা নেই আমাদের।’

ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ বড় বোনের প্রিয় বই। তিনি বলেন, ‘এটা একটা সায়েন্স ফিকশন। কিন্তু এটা সৌদি আরবে বাস্তবে ঘটছে। আপনার সমস্ত জীবন সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে।’ ছোট বোনটি (১৮) বলেন, ‘দেয়ালে ঠেস দিয়ে কান্নার সময় শেষ। কারণ, তুমি যতই কাঁদবে, পরিস্থিতি ততই খারাপ হবে...তাই লড়তে হবে নিজের মতো করে আর খুঁজে নিতে হবে নিজের পথ।’ তাঁরও কোনো অনুশোচনা নেই জানিয়ে বলেন, ‘সমানে একটা সুন্দর, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।’

সৌদি থেকে পালিয়ে আসার এটাই প্রথম ঘটনা নয়; এর আগেও ২০ বছর বয়সী এক তরুণী পালিয়ে থাইল্যান্ড হয়ে কানাডায় আশ্রয় নেন। সে সময়ও ব্যাংককের সৌদি মিশন কোনো মন্তব্য করেনি।


ওই ঘটনায় বিশ্বব্যাপী সৌদি আরবের কঠোর সামাজিক অনুশাসনের ব্যাপারটি আলোচনায় চলে আসে। তবে সম্প্রতি সময়ে দেশটি নারীদের কিছুটা অধিকার দিয়েছে। এখন নারীরা স্টেডিয়ামে প্রবেশ ও গাড়ি চালাতে পারেন।