একদিকে নরেন্দ্র মোদি, অন্যদিকে সবাই

>
  • ভারতের লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
  • বিরোধীরা হাত ধরাধরি করে বাঁচতে চেয়েছে
  • আঞ্চলিক দলগুলোর তাগিদ ও রসায়নের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি
নরেন্দ্র মোদি ও রাহুল গান্ধী
নরেন্দ্র মোদি ও রাহুল গান্ধী

একটুও বাড়াবাড়ি মনে হবে না যদি বুক ঠুকে বলি, এবার, মানে এই ২০১৯-এ ভারতের লোকসভা নির্বাচনটা হচ্ছে নিতান্তই ‘একপেশে’। একপেশে শব্দটা পড়ে মনে হতেই পারে যে এবারের ভোটে আদৌ কোনো লড়াই হচ্ছে না। ১১ এপ্রিল শুরু হতে যাওয়া ভোটে কারা জিতছে, কারা হারছে, তা যেন ভোটের আগেই সবার জানা। ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। একপেশে মানে, লোকসভার মোট ৫৪৩ আসনের একদিকে যেন একজনই প্রার্থী। এক ও অদ্বিতীয় নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। অন্যদিকে তাঁর বিরুদ্ধে অন্য সবাই।

নির্ভেজাল সত্য এটাই। এই প্রথম ভারতের ভোটে লড়াইটা হতে চলেছে একের বিরুদ্ধে অন্যদের। এমন লড়াই আগে কখনো হয়নি।

খুব ভেবেচিন্তেই শাসক দল বিজেপি এই ছকটা কষেছে। পাঁচ বছর আগে, ২০১৪ সালের ভোটে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিজেপি এই ছকটাই পরীক্ষা করতে চেয়েছিল। জাতীয় পর্যায়ে আনকোরা মোদিকে করা হয়েছিল বিজেপির প্রধান মুখ। কিন্তু একমাত্র মুখ তিনি ছিলেন না। প্রচারে ছিল দিনদয়াল উপাধ্যায়, অটলবিহারি বাজপেয়ি, লালকৃষ্ণ আদভানিদের মুখ। ভোটের পর যখন দেখা গেল পরীক্ষা সফল, মোদির মাথা গগনচুম্বী, মোদিও তখন আত্মপ্রচারকে হাতিয়ার করে ‘ওয়েস্টমিনস্টার কাঠামোয়’ তৈরি গণতন্ত্রী ভারতের শাসনপদ্ধতি ও ভোটকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রেসিডেনশিয়াল’ ধাঁচে রূপান্তর ঘটিয়ে দিলেন। সরকার বলতে তিনিই, দল বলতেও তিনি। স্রষ্টাকে ছাপিয়ে সৃষ্টির মাথা তোলার মতো মোদি ক্রমেই উঁচু করেছেন নিজের মাথা। আজ দেশের ৫৪৩ কেন্দ্রে তিনিই শাসক জোটের একমাত্র প্রার্থী! এমন নির্বাচন গণতন্ত্রী ভারত আগে দেখেনি।

বিড়ম্বিত ও বিচলিত বিরোধীকুল একে অন্যের হাত ধরাধরি করে বাঁচতে চেয়েছে। কিন্তু আঞ্চলিক দলগুলোর তাগিদ ও রসায়নের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র সেই প্রচেষ্টা সফল হতে দেয়নি। সর্বভারতীয় দল হয়ে ওঠা বিজেপির মোকাবিলা যে আর একটি সর্বভারতীয় দল কংগ্রেসের পক্ষেই সম্ভবপর, সেই সত্য আঞ্চলিক দলগুলোর সবাই মানতে চায়নি। দেশের বদলে তাদের কাছে মুখ্য রাজ্যের স্বার্থ। তাই তত্ত্বগতভাবে জোটবদ্ধতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি সত্ত্বেও রাজনৈতিক স্বার্থে সেই জোট অধরা থেকে যায়। উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশায় কংগ্রেস তাই ব্রাত্য।

ব্রাত্য হলেও কংগ্রেসই কিন্তু সর্বভারতীয় স্তরে মোদির চ্যালেঞ্জার। অথচ শতাব্দীপ্রাচীন এই দলকে দুরমুশ করে ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গঠনের ডাক দিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন মোদি। মাত্র ৪৪টা আসন জিতে কংগ্রেসও নিজেকে হাস্যকর পর্যায়ে টেনে নামিয়েছিল। তা এতটাই যে লোকসভার বিরোধী নেতার আনুষ্ঠানিক সম্মানটুকু পাওয়ার দাবিও তারা হারিয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে পাঁচ বছরে মোদির একমাত্র চ্যালেঞ্জার হয়ে ওঠা কংগ্রেস অবশ্যই ‘ফিনিক্স পাখির’ সঙ্গে তুলনীয়। এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে এবারের ভোটে ‘মোদি অ্যান্ড কোং’-এর যাবতীয় আক্রমণও একমুখী। ব্রাত্য কংগ্রেসই নরেন্দ্র মোদির পথের সবচেয়ে তীক্ষ্ণ কাঁটা।

ক্ষয়েছে বিজেপিও। আগেরবার জেতা ৯টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৭টিতে গত বছর বিভিন্ন উপনির্বাচনে তারা হেরেছে। যে ২টি জিতেছে, সেগুলো উত্তর-পূর্বে। বিধানসভার উপনির্বাচন হয়েছে ১৬টায়। বিজেপি জিতেছে মাত্র ২টিতে। গুজরাট বিধানসভা ভোট বিজেপি জিতেছে কেঁদে-ককিয়ে। ওখান থেকেই রাহুল গান্ধীর কংগ্রেসের উত্থান। শত চেষ্টা করেও কর্ণাটকে সরকার গড়তে বিজেপি ব্যর্থ। নেপোর দই মারার মতো শেষ হাসি হাসেন কংগ্রেসের রাহুল ও জেডিএসের কুমারস্বামী। জোটবদ্ধ এই দুই দল কর্ণাটকে বিজেপির পথে কাঁটা হয়ে রয়েছে। গোবলয়ের তিন রাজ্য রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে বিজেপিকে হারিয়ে রাহুল প্রমাণ করেছেন, ক্ষয় হলেও কংগ্রেসের বিনাশ নেই। কংগ্রেসের এই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা মোদিকে বাধ্য করেছে উন্নয়ন, বিকাশ ও সুশাসনের দাবি থেকে সরে এসে হিন্দুত্ববাদ, জাতীয়তাবাদ, নিরাপত্তা, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, দেশপ্রেমকে আঁকড়ে ধরতে। বলা হচ্ছে, এই লড়াইয়ে শামিল স্রেফ দুটি পক্ষ—দেশপ্রেমী ও পাকিস্তানপ্রেমী!

এর ফলে ভারতের নির্বাচনী আকাশ ছেয়েছে ঘন কালো আশঙ্কার মেঘে। বিরোধীরা মনে করছে, আরও একবার মোদির ক্ষমতাসীন হওয়ার অর্থ প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতার পূর্ণ বিসর্জন। সুপ্রিম কোর্ট, সিবিআই, রিজার্ভ ব্যাংক, নির্বাচন কমিশন, ভিজিল্যান্স কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধিকার ও স্বশাসন ইতিমধ্যেই প্রশ্নের মুখে। রাজ্য সরকারগুলোর স্বাধিকারে হস্তক্ষেপের অভিযোগও ভূরি ভূরি। কোনো দিন যা হয়নি, এই পাঁচ বছরে সেটাও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে—সেনাবাহিনীর রাজনৈতিকীকরণ। বিরোধীদের আশঙ্কা, এই মোদির আরও একবার ক্ষমতাসীন হওয়ার অর্থ ভারতের বহুত্ববাদী চরিত্রের পূর্ণ অবসান। অথচ আশঙ্কা দূরীকরণে প্রয়োজন ছিল জোটবদ্ধ হওয়া, বিরোধীরা তাতে নিদারুণ ব্যর্থ।

কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ক্ষোভ এবং মোদির প্রতি বিশ্বাসে ভর দিয়ে পাঁচ বছর আগে বিজেপির একক উত্থান। পাঁচ বছর পর এই প্রথম সর্বভারতীয় পর্যায়ে মোদির মূল্যায়ন হতে চলেছে। কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি, তীব্র কৃষি অসন্তোষ, সামাজিক ও ধর্মীয় অসন্তোষ, থমকে যাওয়া শিল্প, ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব মোদির ভাবমূর্তির জৌলুশ ফিকে করেছে। আনকোরা মোদি পাঁচ বছর আগে পেয়েছিলেন ৩১ শতাংশ মানুষের সমর্থন। তখন বিরোধীরাও ছিল ছাড়া ছাড়া। আজ উত্তর প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খন্ড, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে বিজেপিবিরোধী জোট জমাট। গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, পাঞ্জাব, উত্তরাখন্ড ও হিমাচল প্রদেশে কংগ্রেসও তার উপস্থিতি ভালোমতো জানান দিয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যে সুবিধা বিজেপির ছিল, নাগরিকত্ব বিলে সংশোধনের উদ্যোগ তা ফিকে করে দিয়েছে। এই বাস্তবতার পাশাপাশি বিজেপি প্রবলভাবে মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশায়। ভোট-পরবর্তী অন্ধ্র প্রদেশ ও তেলেঙ্গানা সম্ভবত বিজেপিকে বন্ধুহীন রাখবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিজেপি কিংবা এনডিএ এককভাবে সরকার গড়ার ম্যাজিক ফিগার কি ছুঁতে পারবে? শহর ও গ্রাম, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত, শ্রমিক ও কৃষক, নবীন ও প্রবীণ, পুরুষ ও নারী সবাই আগেরবার মোদি নামক স্বপ্নের ফেরিওয়ালাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। এবার? জমাটি ভাব আলগা হয়েছে। সংশয়ও বাড়ছে। প্রচারে তাই শুধুই সেনা বিক্রম, পাকিস্তানকে প্রত্যাঘাত, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ।

তবু সত্য হলো, ভালোয়-মন্দয় মেশানো শাসক দলের অবিসংবাদিত নেতা রয়েছেন একজন—নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। অন্যদিক মুখশূন্য। নেতাহীনতা। কোন পক্ষকে বেছে নেবে ভারতের জনতা?

এই প্রশ্ন সামনে রেখে লোকসভার ৫৪৩ আসনে ভোট শুরু হচ্ছে ১১ এপ্রিল। এবার ভোট হবে ৭ ধাপে। প্রথম ধাপে ১১ এপ্রিল ৯১ আসনে, দ্বিতীয় ধাপে ১৮ এপ্রিল ৯৭ আসনে, তৃতীয় ধাপে ২৩ এপ্রিল ১১৫ আসনে, চতুর্থ ধাপে ২৯ এপ্রিল ৭১ আসনে, পঞ্চম ধাপে ৬ মে ৫১ আসনে, ষষ্ঠ ধাপে ১২ মে ৫৯ আসনে এবং সপ্তম ধাপে ১৯ মে ৫৯ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

সব প্রশ্নের জবাব মিলবে ২৩ মে। ভোট গণনা শেষে ওই দিন জানা যাবে ফলাফল।