তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় শান্তি আসবে?

তালেবান ২০০১ সালের পর এখনই আফগানিস্তানের সবচেয়ে বেশি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে
তালেবান ২০০১ সালের পর এখনই আফগানিস্তানের সবচেয়ে বেশি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে

১৮ বছরে এবারই প্রথম আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্র খুব গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে অবশেষে শেষ হবে ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধ।

গত বছরের অক্টোবরের পর যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান প্রতিনিধিরা সর্বমোট পাঁচ দফায় আলোচনায় বসেছেন। আবার আলোচনায় বসতে যাচ্ছে এই দুই পক্ষ। উদ্দেশ্য সফল হলে যুক্তরাষ্ট্র অফগানিস্তান থেকে সব সেনা সরিয়ে নেবে। এই প্রথম সমাধানের এতটা কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে বলেও একমত প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। তবে কাতারের দোহায় বৈঠক শেষে তালেবান জানায়, এটা দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া। ফলাফলের জন্য তাদের আরও অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে।

এই বৈঠকে প্রত্যাশা কী?
দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে যে সংকট চলছে, কয়েকটা বৈঠকে ম্যাজিকের মতো সব ঠিক হয়ে যাবে—এমনটা আশা করা ভুল। সেই ভুল করছেন না বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকেরাও। কিন্তু রাশিয়ায় তালেবান ও আফগান প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যে এক সম্মেলনকক্ষে শান্তি আলোচনার জন্য বসেছেন, এটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ইতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান বাহিনী আফগানিস্তানে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। আবার রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পুরোপুরি আস্থার সম্পর্ক আছে—এমনটা বলা যাবে না। এ রকম পরিস্থিতিতে, সব পক্ষের একসঙ্গে আলোচনায় বসা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই বৈঠক তাই আশার জন্ম দেয়।

যুদ্ধবিরতি ঘটবে?
আফগানিস্তানজুড়ে এখনো যুদ্ধ চলছে। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে তালেবান এখন আফগানিস্তানের সব থেকে বেশি অঞ্চল দখল করে রেখেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একাধিকবার বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনার সাপেক্ষে এই যুদ্ধের যবনিকা টানার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। প্রতিবছর মার্কিন কোষাগার থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি ডলার খরচ হয় এই যুদ্ধে! আফগানিস্তান থেকে প্রায় ১৪ হাজার সেনা প্রত্যাহারের আগ্রহ তালেবান সহ সবাইকেই অবাক করেছে।
ন্যাটোর একটি মিশনের অংশ হিসেবে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে প্রায় এক হাজার ব্রিটিশ সেনাও মোতায়েন সেখানে।
আলোচনার সুবিধার্থে ধরে নিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবান গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে সমঝোতায় পৌঁছাবে। কিন্তু এরপরও অভ্যন্তরীণ অনেক বিষয় নিয়ে জটিলতা থেকেই যাবে। এর মধ্যে সরকার গঠন ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও রয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচনের খাতিরে হলেও এই বছরের শেষের দিকে তালেবান যুদ্ধবিরিতিতে যাবে এবং নির্বাচনে অংশ নেবে। কিন্তু এরপর কী ঘটবে, সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না।

ক্ষমতার ভাগাভাগি সম্ভব?
এই প্রশ্নের উত্তরে অনেক সম্ভাবনা ও দৃশ্যপট রয়েছে। এমন হতে পারে, সব বড় দলের হর্তাকর্তারা এক হয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে। যদি ভালোয় ভালোয় তা হয়, তাহলে নতুন সরকার তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বসবে। এই আলোচনায় আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা কীভাবে ভাগাভাগি করা যায়, সেই বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। এ পর্যন্ত যাওয়ার আগেই অনেক ‘যদি, কিন্তু, তবে’ পার হতে হবে।
এ ক্ষেত্রে সবাই মিলে নির্বাচনের জন্য একটি নিরপেক্ষ বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও গঠন করা যেতে পারে। তবে হ্যাঁ, আগে মার্কিন সেনাবাহিনীকে আফগানিস্তান ছাড়তে হবে। কয়েকজন তালেবান নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলধারার আফগান সমাজকে ফিরিয়ে আনতে ও নির্বাচনের জন্য আফগানিস্তানকে প্রস্তুত করতে এখনো অনেক সময়ের প্রয়োজন বলেই তাঁরা মনে করছেন।

তালেবান ২০০১ সালের পর এখনই আফগানিস্তানের সবচেয়ে বেশি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে
তালেবান ২০০১ সালের পর এখনই আফগানিস্তানের সবচেয়ে বেশি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে


পূর্বের শত্রুরা একসঙ্গে কাজ করবে?
সবকিছু যদি ঠিকঠাক থাকলেও নির্বাচনের পর সরকার পক্ষ, বিরোধী পক্ষ ও বেসামরিক জনগণ—সবাইকে এক করে আফগানিস্তানের জন্য কাজ করাটা হবে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। যেমন, তালেবানরা আফগানিস্তানের বর্তমান সংবিধান মানে না। তারা আফগান সরকারকে মনে করে ‘যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল সরকার’। এই বিদ্রোহীরা প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণির সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনায় বসতে রাজি হয়নি। আবার সাধারণ আফগানদের অনেকে মনে করছেন, তালেবানের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করলে তারা ইসলামি শাসনব্যবস্থায় বাজেভাবে হস্তক্ষেপ করবে। বিশেষ করে নারীদের স্বাধীনতা ও অধিকার বলে কিছু থাকবে না। এর আগে ১৯৯০–এর দশকে তালেবানরা ক্ষমতায় থাকার সময় আফগানিস্তানের সব নারীর বাইরে বের হওয়া নিষেধ ছিল। শাস্তিস্বরূপ ওই নারীদের জনসম্মুখে পাথর ছুড়ে মারা হতো এবং শরীরের অঙ্গ কেটে ফেলা হতো।

আলোচনায় যদি শান্তি না আসে?
এতক্ষণ যা কিছু আলোচনা হলো, তা অত্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টিকোণে, বৈঠক সফল হবে ধরে নিয়ে। কিন্তু, আলোচনা যদি ভেস্তে যায়? কত আলোচনাই তো শুধু দুই পক্ষের করমর্দন আর হাসির ছবিতেই শেষ হয়। এ ক্ষেত্রেও যদি তা–ই হয়? ১৯৭৯ সালের সোভিয়েত আগ্রাসন পর থেকেই আফগানিস্তানে ব্যর্থ বৈঠক আর চুক্তির লম্বা তালিকা রয়েছে। এগুলোর কোনোটাই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারেনি। গত চার বছরের আফগান যুদ্ধে অন্তত ৪৫ হাজার পুলিশ ও আফগান সেনার মৃত্যুর খরব সংবাদমাধ্যমের রসদ জুগিয়েছে। কাবুলের এই বৈঠক ব্যর্থ হলে আগফান সরকার আর্থিক ও সামরিক—উভয় দিক থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। তালেবান এখন আফগানিস্তানের প্রায় ৭০ শতাংশ দখল করে রেখেছে। তাই আলোচনা বিফলে গেলে তারা যে আফগানিস্তান দখল করে নেবে না, এমনটাও বলা যায় না। আবার আফগানিস্তানসহ বাকি বিশ্বকে আল-কায়েদা ও আইএসের থেকে নিরাপদ রাখাটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

বৈঠক কীভাবে সফল হবে?
দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা চরম সংকট নিরসনে আলোচনা খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের একটা পদক্ষেপ। এর সামনে পড়ে থাকে অত্যন্ত জটিল এবং চ্যালেঞ্জের দীর্ঘ পথ। দুই পক্ষ কোনো একটি বিষয়ে সম্মত হলেই যে বৈঠক সফল হয়েছে, তা বলা যাবে না। বরং তারা যে কাগজে স্বাক্ষর করেছে, সেগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব হলেই আলোচনা সফল বলে ধরে নেওয়া যায়। সব পক্ষকে তাই শান্তির জন্য আন্তরিক হতে হবে। যেকোনো পক্ষের সামান্য ভুলেই পুরো সমঝোতার বিষয়টিই তছনছ হয়ে যেতে পারে। চার দশক ধরে চলে আসা এই যুদ্ধ অবশেষে শেষ হবে—প্রথমবারের মতো এটি সত্যি হওয়ার খুব কাছাকাছি একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে। রুদ্ধশ্বাসে এই পরিস্থিতিতে সব পক্ষকে এখন তাই অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে এগোনো ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই।