আতঙ্কের খেরবাড়িতে ভোটের উত্তাপ নেই

সন্ত্রাসী হামলায় নিহত পাঁচ বাঙালির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে খেরবাড়িতে নির্মিত ‘শহীদ বেদি।’ ছবি: প্রথম আলো
সন্ত্রাসী হামলায় নিহত পাঁচ বাঙালির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে খেরবাড়িতে নির্মিত ‘শহীদ বেদি।’ ছবি: প্রথম আলো

ভোটের কোনো উত্তাপ নেই খেরবাড়িতে। শোক আর ক্ষোভের মধ্যে আছে আতঙ্কও। পাঁচ মাস পরেও আতঙ্ক কাটেনি আসামের বাঙালি প্রধান গ্রামটি থেকে। ক্ষোভ রয়েছে বিচার না পাওয়ার। কারা খুন করলেন? সে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই গ্রামবাসীর। তাঁরা শুধু জানেন, বাঙালি হওয়ার কারণেই দিতে হয়েছে প্রাণ।

আসামের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে ৫১৮ কিলোমিটার দূরে জেলা সদর তিনসুকিয়া। খনিজ তেল, চা–বাগান ও কয়লার খনি সমৃদ্ধ এই জেলা আসামের অন্যতম বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র। তিনসুকিয়া শহর থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরে, চীন সীমান্তবর্তী অরুণাচল প্রদেশের সঙ্গে সংযোগকারী প্রধান সড়ক থেকে কিছুটা গেলে হাতের বাঁদিকে খেরবাড়ি গ্রাম। বর্ধিষ্ণু কৃষিপ্রধান এলাকা। গ্রামের মানুষ আশপাশের শহরবাসীদের বারো মাস সবজি সরবরাহ করে থাকেন। চাষবাস করে চলে তাঁদের সংসার। প্রতিবছর বন্যা এখানকার মানুষের গা-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু গত বছর বন্যার পানি ঢোকেনি গ্রামে। হয়েছিল ‘গুলি বৃষ্টি।’
১ নভেম্বর, ২০১৮। গোটা অসম উত্তপ্ত নাগরিক নিবন্ধীকরণ (এনআরসি) নিয়ে। সন্ধ্যায় জনাসাতেক সশস্ত্র ব্যক্তি গ্রামের ছয়জনকে ডেকে নিয়ে যান সইখুয়া নালার ধারে। বলেন, কথা আছে। ছয়জনকেই পেছন ফিরে বসতে বলেন। তারপর কথা বলে তাঁদের বন্দুক। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন অবিনাশ বিশ্বাস (২২) ও তাঁর ভাই অনন্ত (১৮), কাকা শ্যামলাল (৫২)। মারা যান খেরিবাড়িরই ধনঞ্জয় নমশূদ্র (২২) ও সুবল দাস (৫৫)। বরাত গুণে বেঁচে যান সহদেব নমশূদ্র। সহদেবের মাথার চুল পুড়িয়ে গুলি বেরিয়ে যায়। ভয়ে অন্ধকারে অজ্ঞান হয়ে নালায় পড়ে গিয়ে প্রাণে বাঁচেন সহদেব। ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী।

খেরবাড়ি এখনো ভুলতে পারেনি শোক। গ্রামের ভেতর কোনো রাজনৈতিক দলেরই পতাকা নেই। গ্রামবাসী সমর বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বাঙালি। রাজনীতিই খেয়েছে আমাদের গ্রামের পাঁচটি প্রাণ।’ দুই ছেলে আর দেবর হারানো শ্যামলী বলছেন, ‘বাবা, বড় দুঃখী আমি। বিচার পাব না! শাস্তি হবে না দোষীদের!’ তাঁর পুত্রবধূ ঊর্মিলা। কোলে দুই বছরের কন্যাসন্তান। মাটির ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন। বললেন, ‘সরকার পাঁচ লাখ টাকা (রুপি) করে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই বাপ মরা বাচ্চাটাকে নিয়ে কী করব! কোথায় যাব!’ শুধু তাঁরা নন, গোটা গ্রামে এখনো শ্মশানের স্তব্ধতা। তাঁরা এখনো যেন বিশ্বাস করেই উঠতে পারছেন না সেই দুঃসহ রাত্রির ঘটনা।
গ্রামবাসী প্রথম খবর পান সহদেবের কাছ থেকে। প্রথম আলোকে সহদেব বলছিলেন, ‘ভালো ভালো বন্দুক’ হাতে ফৌজি পোশাক পরা জনাসাতেক লোক তাঁদের হিন্দিতে বলে, সঙ্গে যেতে। কথা আছে। তবে তাঁরা নিজেরা কথা বলে অসমিয়াতেই। সবার মুখ ছিল কালো কাপড়ে ঢাকা। তারপর নালার পারে বসতে বলা হয় তাঁদের।

সহদেব বলছিলেন, ‘হঠাৎ শুনি গুলির আওয়াজ। ভয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যাই নালায়। ওরা আমায় দেখতে পায়নি।’

তারপর পাঁচ মাস কেটে গেলেও আতঙ্ক যায়নি সহদেবের। বাড়ির বাইরে বলতে শুধু নিজেদের চাষের জমিতেই যান এখন। সন্ধ্যার পর ঘর থেকেই বের হন না তিনি।
কারা এসেছিল সেদিন? আসাম সরকার বলছে, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন উলফার স্বাধীন গোষ্ঠী। কিন্তু উলফা অস্বীকার করেছে। গ্রামবাসীও বিশ্বাস করছেন না সে কথা। দুই সন্তান ও ভাইকে হারানো মোহনলালও মানতে নারাজ। তিনি বলেন এই গ্রামে কখনো হামলা করেনি উলফা। বর্ষার মৌসুমে তাঁদের কাছ থেকে মাছ কিনেছে কখনো কখনো। তবে সেটা পয়সা দিয়ে।

উলফার আলোচনাপন্থীদের চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়ার দাবি, এই কাজ তাঁরা করতেই পারেন না। কারণ, তাঁরা তো সবাই আসামের বাসিন্দা। বাংলায় কথা বললেও তাঁরা অসমিয়াই।

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল বলেছিলেন, দোষী ব্যক্তিরা শাস্তি পাবে। কিন্তু এখনো কেউ গ্রেপ্তারই হয়নি। একজন ‘লিঙ্কম্যান’ আটক হয়েছিল বটে, এখন সেও মুক্ত।
বাঙালি গ্রামটির বাসিন্দাদের সবারই রয়েছে এনআরসি তালিকায় নাম। সবাই বহু বছর ধরে বসবাস করছেন। গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো ভাবতেই পারছেন না তাঁরাও হতে পারেন ‘রাজনীতি’র শিকার। ঘটনার পর বসেছিল আধা সেনার অস্থায়ী ছাউনি। এখন সেটাও নেই। তাই ভোট মৌসুমে আসামের লখিমপুর লোকসভা কেন্দ্রে খেরবাড়ি আতঙ্কের প্রহর গুনছে।