আজও উদ্ঘাটিত হয়নি সে রহস্য

ইয়েসের মুর্তাজার মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গোরস্থানে। গাজা শহর, ৭ এপ্রিল। ছবি: এএফপি
ইয়েসের মুর্তাজার মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গোরস্থানে। গাজা শহর, ৭ এপ্রিল। ছবি: এএফপি

ঠিক এক বছর আগের কথা। দিনটা ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল। ৩০ বছর বয়সী আলোকচিত্রী ইয়াসির মুর্তাজা তাঁর ড্রোন ক্যামেরায় গাজা ও ইসরায়েল সীমান্তের এক খুদে ছিটমহলের কিছু ছবি ধরে রাখছেন। পরদিন ৬ এপ্রিল এখানে বড় ধরনের বিক্ষোভ হওয়ার কথা।

ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও ২০ লাখ মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাসকে বিক্ষোভের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। গত বছরের শুরুতে তারা ঠিক করে, প্রতি শুক্রবার ইসরায়েল ও গাজা সীমান্তে সবাই মিলে বিক্ষোভ করবে। ‘গ্রেট মার্চ আব রিটার্ন’ নামের ওই বিক্ষোভের প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হয় গত বছর ৩০ মার্চ।

এর ধারাবাহিকতায় ৬ এপ্রিল শুক্রবারটি ছিল দ্বিতীয় বিক্ষোভের দিন। শার্টের ওপর ‘প্রেস’ লেখা বুলেটপ্রুপ জ্যাকেট চাপিয়ে ঘটনা তুলে ধরতে রওনা দেন মুর্তাজা।

পরিষ্কার আকাশ। রোদে উজ্জ্বল চারদিক। হাজারো বিক্ষোভকারী শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে চলেছে। তাদের দিকে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া হয়েছে। দুপুরের কিছু পরে, কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় সৃষ্ট মেঘের মধ্যে ছবি তুলছিলেন মুর্তাজা। এমন সময় সীমান্তের ওপার থেকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর স্নাইপারের (আড়াল চোরাগোপ্তা গুলি ছোড়া ব্যক্তি) ছোড়া গুলি এসে বিদ্ধ হয় তাঁর তলপেটে।

রুশদি সারাজ মুর্তাজার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ব্যবসায়িক সহযোগী। সেদিনটা স্মরণ করে টাইম পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা একসঙ্গেই ছিলাম। প্রত্যেকে নিজেদের ক্যামেরায় বিক্ষোভের বিশেষ দৃশ্য বা ঘটনা তুলে রাখছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘কিছুক্ষণ পর হঠাৎ লোকজন চিৎকার শুরু করে—একজন সাংবাদিকের গুলি লেগেছে।’

মুর্তাজাকে যখন রুশদি খুঁজে পান, তিনি বলেন, ‘রিপোর্টিং জ্যাকেট পরা অবস্থায় তিনি মাটিতে পড়ে ছিলেন, তাঁর মুখ বেদনায় বিবর্ণ।’

এরও ১২ ঘণ্টা পর মুর্তাজা মারা যান। ওই বিক্ষোভে ইসরায়েল বাহিনীর হাতে প্রায় ২০০ গাজাবাসী নিহত হন।

মুর্তাজার মৃত্যুর এক বছর হতে চলল। কিন্তু ঘটনাটির এখনো কোনো সমাধান হয়নি, বরং আটকে পড়েছে এক কানাগলিতে।

মুর্তাজার মৃত্যুতে আন্তর্জাতিক মহলে হইচই পড়ে যায়। নানা দিক থেকে আসা সমালোচনার ঢেউ বয়ে যায়। এটা সামাল দিতে সে সময় ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ঘোষণা দেয়, তারা মুর্তাজার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করবে। ঘোষণা দিয়েই তারা পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়ে যায়।

মুর্তাজার মৃত্যুর ১১ মাস পরে ঘটনাটির তদন্ত কত দূর ইসরায়েল সেনাবাহিনীর কাছে জানতে চেয়েছিল সংবাদমাধ্যম লস এঞ্জেলেস টাইম। সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র তাদের জানান, ‘মুর্তাজার ব্যাপারটি ‘জেনারেল স্টাফ ফ্যাক্টস অ্যাসেসমেন্ট মেকানিজম’–এর আওতায় তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্ত শেষে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত সামরিক অ্যাডভোকেট জেনারেল অফিসে পাঠানো হবে।’

এপ্রিলের ৮ তারিখ। মুর্তাজার মৃত্যুর পরদিন ইসরায়েলের সেনাবাহিনী একটি বিবৃতি দেয়। তারা দাবি করে, সেনাবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে ওই সাংবাদিককে গুলি করেনি। গুলি ছোড়ার যে অভিযোগ আইডিএফের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, ওই সময় ঠিক কী ধরনের পরিস্থিতি ছিল, তাও তাদের কাছে অজানা এবং তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

এরপর কোনো অনুসন্ধান বা প্রমাণ ছাড়াই ইসরায়েলের কর্মকর্তারা মুর্তাজাকে ‘হামাস জঙ্গি’ বলে দাবি করেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ দাবি ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।

মুর্তাজা ও সারাজ কখনোই সাংবাদিক হতে চাননি। মুর্তাজা পড়েছিলেন হিসাববিজ্ঞানে আর সারাজ প্রকৌশলে। তাঁদের দুজনের একটি মিল ছিল। তাঁরা আলোকচিত্র ভালোবাসতেন। এটাই তাঁদের দুজনকে কাছাকাছি নিয়ে আসে।

তাঁরা ২০ বছরে পা রাখলেন, ফেসবুকে একটি পেজ খোলেন ‘আইন আল গাজা’ (দৃষ্টিতে গাজা) নামে। এই পেজে দুজনে প্রকাশ করতেন অবরুদ্ধ গাজাবাসীর দুর্দশাময় জীবনযাপনের নানা চিত্র।

বর্তমানে ৩৫ বছর বয়সী রাজ বলেন, ‘এই শখই আমাদের আপন করে তোলে। আমাদের আগ্রহ দিন দিন বাড়তে থাকে। সারাক্ষণ আমরা ফুটেজ ধারণ করতাম, যখন কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তাব আসত, আমরাই থাকতাম সর্বশেষ তথ্যসমৃদ্ধ।’

২০১২ সালে দুজনে সিদ্ধান্ত নেন শখকে তাঁরা পেশায় পরিণত করবেন। ‘আইন মিডিয়া’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন তাঁরা।

শুরুতে তাঁরা একটি ক্যামেরা ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতেন। কিন্তু দ্রুতই আইন মিডিয়া আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার নজরে চলে আসে। সংস্থাগুলো আইন মিডিয়াকে বিভিন্ন কাজ দেয়। ফলে তাঁরা সর্বশেষ প্রযুক্তি কেনার মতো টাকা জমিয়ে ফেলেন। সে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেন ১৫ জন কর্মচারী।

গত বছর মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র বিভাগ আইন মিডিয়াকে একটি চিঠি পাঠায়। চিঠিতে তারা জানায়, আইন মিডিয়াকে যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি সহায়তার জন্য ১১ হাজার ৭০০ ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে। তাঁরা এই অর্থ পাবেন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির মাধ্যমে।

সারাজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের দেওয়া ওই অর্থ আইন মিডিয়ার গ্রাফিক বিভাগ খুলতে সাহায্য করত। ইউএসএআইডিয়ের মাধ্যমে ওই টাকা দেওয়া হতো ফিলিস্তিনের ব্যক্তিগত খাতগুলোর উন্নয়নে। ট্রাম্প প্রশাসন ফিলিস্তিনের জন্য বরাদ্দ সব সাহায্য বাতিল করে। এর অংশ হিসেবে ওই অর্থও বাতিল হয়ে যায়।

মুর্তাজা গত বছর মার্চের ২৪ তারিখে তাঁর ফেসবুকে ড্রোনে ধারণ করা কিছু ছবি পোস্ট করে বলেন, ‘এমন দিন কি আসবে, যেদিন আমি বিমান থেকে এই ছবিগুলো ধারণ করতে পারব, মাটি থেকে নয়। আমার নাম ইয়াসির মুর্তাজা। বয়স ৩০ বছর। আমি গাজা শহরে বাস করি। আমি কখনো ভ্রমণ করিনি!’

মুর্তাজা নিহত হওয়ার পরের দিন, এপ্রিল ৮ তারিখ, ইসরায়েলের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাভিদো লিবামান বলেন, ‘প্রায় ডজনখানেক ঘটনায় আমরা দেখেছি, হামাস কর্মীরা সাংবাদিক ও চিকিৎসকের ছদ্মবেশে তৎপরতা চালাচ্ছে। আমরা আরও দেখলাম, একজন সাংবাদিক সীমান্তের কাছে ড্রোন উড়াচ্ছে। আমরা কিন্তু এসব ঘটনার সুযোগ নিইনি।’

লিডামান বলেন, সন্ত্রাসীদের ওই মিছিলে কোনো ভালো মানুষ থাকতে পারে না। তারা সবাই হামাস।’

মুর্তাজা ও সারাজ তাঁদের কাজে প্রায়ই ড্রোন ব্যবহার করতেন। এর আগে বিবিসির একটা ডকুমেন্টারিতে এবং চীনের শিল্পী আই ওয়েইওয়েইয়ের একটি কাজে তাঁদের ড্রোনে ধারণ করা ছবি ব্যবহৃত হয়েছে। তবে সরাজ জানান, মুর্তাজা যেদিন গুলিবিদ্ধ হয় সেদিন সে ড্রোটটি অফিসে রেখে গিয়েছিল।’

এপ্রিলের ১০ তারিখে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মুখপাত্র ডেভিড কেয়েস এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘এটা প্রমাণিত, গাজায় নিহত “আলোকচিত্রী” হামাস নামের সন্ত্রাসী সংগঠন, যারা ইসরায়েলের ধ্বংস চায়, তাদের একজন কর্মকর্তা। সে ২০১১ সাল থেকে হামাসের বেতনভুক্ত কর্মচারী। ইসরায়েলের অবস্থান জানার জন্য সে ড্রোন ব্যবহার করত। অসংখ্য প্রতিবেদক তাঁকে সাংবাদিক বলছেন। তাঁরা কি এই রেকর্ড সংশোধন করে দেবেন?’

এপ্রিলের ১২ তারিখে ইসরায়েল সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল জোনাথন কনরিকাস বলেন, মুর্তাজা ‘সন্ত্রাসী সংগঠন হামাসের নিরাপত্তা ফোর্সে ক্যাপ্টেন সমমানের কর্মকর্তা ছিলেন।’

মুর্তাজার পারিবার ও সহকর্মীরা হামাসের সঙ্গে তাঁর সব ধরনের যোগাযোগ রাখার কথা অস্বীকার করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারও সব শর্ত পূরণের পরই কেবল আইন মিডিয়াকে ইউএসএআইডির অর্থ সাহায্য দিয়েছিল।

মুর্তাজার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পরে টাইম পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেন নেতানিয়াহুর মুখপাত্র কেয়েস। সেদিন তিনি বলেন, ‘হামাসের সঙ্গে মুর্তাজার যোগাযোগের বিষয়ে আমাকে উদ্ধৃত করতে পারেন; মুর্তাজা এক শ শতাংশ হামাসের কর্মকর্তা ছিলেন। আমি নিজে গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেখেছি। এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।’

মুর্তাজার মৃত্যুর ঘটনা এক বছর পার হলেও কী পরিস্থিতিতে তাঁকে মারা হলো, এখনো তা প্রকাশ করতে পারেনি ইসরায়েল। তারা প্রমাণ করেনি, মুর্তাজা ওই দিন ড্রোন ব্যবহার করছিলেন। মুর্তাজা কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন—এমন কোনো সাক্ষীও তারা হাজির করতে পারেনি।

সারাজ মনে করেন, ওই দিন ইসরায়েলি স্নাইপার জেনেশুনেই মুর্তাজাকে নিশানা করে। তারপর একটি বিস্ফোরক বুলেট ছোড়ে। ঠিক এ কারণেই ইসরায়েলি সেনারা কোনোরকম তদন্ত করছেন না। তিনি বলেন, ইসরায়েলি বাহিনী নিয়মিত সব জায়গায় ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে।