পাটিগণিতে জোট এগিয়ে, প্রশ্ন রসায়নের

ভদ্রলোক মারা গেছেন তা প্রায় বত্রিশ বছর হয়ে গেল। তাঁর বয়স যখন সাতাত্তর, ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসের শেষে তখন মাত্র সাড়ে পাঁচ মাসের জন্য তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। বেঁচে থাকলে এখন চৌধুরী চরণ সিংয়ের বয়স হত ১১৭ বছর।

এই যে ‘বেঁচে থাকলে’ শব্দ দুটো লিখলাম, লিখেই বুঝলাম কী ভুল কী ভুলই না করলাম। উত্তর প্রদেশের এই বিস্তীর্ণ পশ্চিমাঞ্চল, যাকে এককথায় এই রাজ্যের ‘হরিৎক্ষেত্র’ বলা হয়, যেখানে মোট ১১টা লোকসভা কেন্দ্রের ভোট হবে প্রথম দফার এই ১১ এপ্রিল, পাঁচ বছর আগে ২০১৪ সালের ভোটে যে আসনগুলো ‘মোদি সুনামিতে’ ভেসে গিয়েছিল, সেখানে শাসক দলের প্রার্থীদের আজ মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাঁর সঙ্গেই। বিরোধী শিবিরের যত ব্যানার, যত হোর্ডিং, যত প্রচার, সর্বত্রই চরণ সিংয়ের জ্বলজ্বলে উপস্থিতি। দেখেশুনে ভ্রান্তি হতে পারে, বাগপত বা মুজফফরনগরে বিরোধী শিবিরের প্রার্থী যথাক্রমে তাঁর নাতি জয়ন্ত ও পুত্র অজিত নন। প্রার্থী যেন চরণ সিং স্বয়ং!

এমনই তাঁর ভাবমূর্তি যে শাসক দল ও সরকারের দন্ডমুন্ডের কর্তা একমেবাদ্বিতীয়ম প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যিনি রাহুল–প্রিয়াঙ্কা তো কোন ছাড়, নেহরু–ইন্দিরাকে পর্যন্ত উঠতে–বসতে গালমন্দ করছেন, তিনি পশ্চিম উত্তর প্রদেশে প্রচারে এসে চরণ সিংয়ের ‘দুর্ভাগ্য ও দুর্দশায়’ হা হুতাশ করেছেন। বলছেন, চৌধুরীসাবের দুর্ভাগ্য, তাঁর পরিবার উচ্ছন্নে গেল। তবে সৌভাগ্য, ওই পারিবারিক দুর্দশা তাঁকে দেখতে হচ্ছে না।

হা হুতাশটা শেষ পর্যন্ত যে তাঁকে করতে হবে না, নরেন্দ্র মোদিকে সেই নিশ্চয়তা দেওয়ার মতো কেউ কিন্তু এই অঞ্চলে বিশেষ নেই। ২০১৪ সাল যতটা তাঁর কাছে মাখনের মধ্যে ছুরি চালানোর মতো মসৃণ ছিল, ২০১৯ হয়ে দাঁড়িয়েছে ততটাই বন্ধুর। গোটা রাজ্যে ভোটের পাটিগণিত মাত করেছেন বুয়া–ভাতিজা জুটি মায়াবতী ও অখিলেশ। বহুজন সমাজ হাত মিলিয়েছে সমাজবাদীদের সঙ্গে। অনগ্রসর যাদব ও তপসিলি জাটভ এককাট্টা করেছে সমাজের প্রান্তিকদের। ধরাধামে না থেকেও হরিৎক্ষেত্রে যিনি উপস্থিত, সেই চরণ সিংয়ের লোকদলকে ছাড়া হয়েছে তিনটি আসন। বাগপত, মুজফফরনগর ও মথুরা। পাটিগণিত ঠিক থাকলে এই জোটবদ্ধতার অর্থ মায়াবতীর ২২ শতাংশ সমর্থনের সঙ্গে যোগ হচ্ছে অখিলেশের ২৩ শতাংশ অনগ্রসর এবং মুসলমান সমাজ। কেকের ওপর ক্রিমের উপস্থিতি জানান দিতে থাকছে লোকদলের জাট সমর্থন। সোজা কথায় মোদি অ্যান্ড কোংয়ের বেবাক সাফ হয়ে যাওয়া।

বাগপতের কাটঠা গ্রামের চৌপালে অঙ্কটা ঠিক এইভাবে কষে নরেন্দ্র সিং জাট দু–তিনটে জরুরি কথা মনে করিয়ে দিলেন। যেমন, ২০১৩ সালে মুজফফরনগরের দাঙ্গাটা হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে ছিল না। ছিল জাট ও মুসলমানে। সেই থেকে জাট ভোট মুসলমান পায় না, মুসলমান ভোটও জাটেরা কম পায়। এবার ওই ভাগাভাগি কমানোর আপ্রান চেষ্টা করেছেন অজিত সিং, অখিলেশ ও মায়াবতী। দেখতে হবে সেই চেষ্টা কতটা সফল হয়। দু নম্বর কথা, উত্তর প্রদেশে এবার এই তিন দলের জোট মোটেই ওপরে ওপরে নয়। বাঁচার তাগিদে একেবারে নীচু তলা পর্যন্ত তা ছড়িয়ে গেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা শুধু মোদির পক্ষেই সম্ভব। সেই ভাবমূর্তি প্রধানমন্ত্রীর আছে। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে, পাঁচ বছর আগে মোদির পোশাকে কোনো দাগ ছিল না। আজ বেশ কিছু ছিটে লেগেছে। চৌপালে বসা হরপাল কাশ্যপ হুঁকোর নল টেনে নিয়ে বললেন, এবারও ভোট হবে মোদির নামে। মোদি দেখিয়েছেন, পাকিস্তানকে কী করে শায়েস্তা করতে হয়।

পশ্চিম উত্তর প্রদেশ হলো আখের ভান্ডার। চরাচর জোড়া শুধু আখের খেত। হাতি লুকোতে পারে এমন উঁচু রসে টইটুম্বুর আখের গোড়া গোছা গোছা করে বেঁধে রাখা হয়েছে। ঝাড়খন্ড ও বিহারী মুনিষেরা আখ কেটে জড় করছে। ট্রাক্টর বোঝাই করা আখ চালান হচ্ছে স্থানীয় চিনি মিলগুলোয়। আখ মাড়াই করে মাঠে তৈরি হচ্ছে গুড়। তাজা গুড়ের গন্ধে ম ম করছে বাতাস। রাজ্যের সবচেয়ে বড় সমবায় চিনি মিলও এই বাগপতেই। সেখানকার কর্তা অনিল শর্মার কথা অনুযায়ী, আখ চাষীদের মধ্যে শুধু এই বাগপতে তাঁর সমবায় মিল বছরে সাড়ে তিন শ কোটি টাকা বিলি করে। এলাকার অর্থনীতির জন্য ওই টাকার গুরুত্ব যতটা, ঠিক ততখানিই গুরুত্বপূর্ণ এই তল্লাটের আখ চাষ ও চিনি–ভিত্তিক রাজনীতি।

কৃষি সঙ্কট বলতে ইদানিং যা বোঝাচ্ছে, পশ্চিম উত্তর প্রদেশে তা আখ চাষের সঙ্কট। চিনির রাজনীতি শুধু বাগপত নয়, পশ্চিম উত্তর প্রদেশের এগার আসনেরই অন্যতম বিধাতা। সেই রাজনীতির কথা এখন বরং থাক। তার চেয়ে গতবারের ওই প্রবল মোদি হাওয়ায় উড়ে যাওয়া বিরোধীকুল ও এই তল্লাটে গেড়ে বসা সত্যপাল সিংয়ের কাহিনিটা সংক্ষেপে বলে দিই।

বাগপতের ভূমিপুত্র সত্যপাল সিং ছিলেন মুম্বাইয়ের পুলিশ কমিশনার। নরেন্দ্র মোদির মতোই শক্তপোক্ত। কাঠিন্যে মোড়া। মোদি হাওয়ায় সোয়া চার লাখ ভোট পেয়ে জিতলেও তাঁর বিরুদ্ধে যাওয়া মোট ভোটের পরিমান ছিল সাড়ে পাঁচ লাখ। সমাজবাদী পার্টির গুলাম মহম্মদ ও রাষ্ট্রীয় লোকদলের অজিত সিং মিলে পেয়েছিলেন চার লাখের কিছু বেশি, বহুজন প্রার্থী প্রশান্ত চৌধুরী দেড় লাখের সামান্য কম। এবার ওই তিন দল এককাট্টা। অজিত সিং নিজে মুজফফরনগরে সরে গিয়ে বাগপত তুলে দিয়েছেন ছেলে জয়ন্তর হাতে। বিরোধী জোটের প্রার্থী জয়ন্তই। কিন্তু তাতে ঘাবড়াচ্ছে না সত্যপালের দল। সাবেক পুলিশ কমিশনারের নির্বাচনী এজেন্ট জয় কুমার কিছুটা হেঁয়ালি করে বললেন, মানুষ জানে, বিজেপি হারলে বাগপত ফের অন্ধকারে ডুবে যাবে। হেঁয়ালির উত্তরও তিনিই দিলেন, সমাজবাদী জমানায় বিদ্যুৎ থাকত দিনে বড় জোর ছয় ঘন্টা। আজ থাকে বাইশ ঘন্টা।

চুপিচুপি গোপন কথা বলার ঢংয়ে আরো একটা তথ্য দিলেন তিনি। পাটিগণিত যাই হোক না, রসায়ন বলেও একটা পদার্থ আছে। সেই রসায়ন তাঁদের পক্ষে দাবি জানিয়ে জয় কুমার বললেন, চরণ সিং কৃষকদের মসিহা। এলাকায় আজও তিনি প্রণম্য। এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই। কিন্তু এটাও সত্য, সত্যপাল পাঁচ বছরে কয়েক শ ছেলের চাকরি দিয়েছেন সেনা ও আধা সামরিক বাহিনীতে। আখ ও গম চাষির ছেলেরা আজ আর ছদ্ম বেকার নয়। মানুষ বুঝেছে, দিল্লিতে মোদি থাকা মানে সুস্থিতির পাশাপাশি চাকরিরও সুবিধা। বিরোধী জোট হলো ‘বারোভুতের কারবার’। মোদির নামেই তাই অন্যদের মতো সত্যপালও ভোট চাইছেন। নরেন্দ্র মোদি তাঁরও আশার প্রদীপ।