কেমন আছে রুয়ান্ডা?

২৫ বছর ধরে দেশটিতে ক্ষমতায় আছেন তুতসি নেতা পল কাগামে। ছবি: এএফপি
২৫ বছর ধরে দেশটিতে ক্ষমতায় আছেন তুতসি নেতা পল কাগামে। ছবি: এএফপি
মানব ইতিহাসের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী রুয়ান্ডা। মাত্র ১০০ দিনে চালানো সেই গণহত্যায় নিহত হয় দেশটির ৮ লাখ মানুষ। বিভীষিকাময় সেই গণহত্যার ২৫ বছর পূর্ণ হলো ৭ এপ্রিল। ১৯৯৪ সালের সেই গণহত্যার পর এখন কেমন আছে আফ্রিকার দেশটি? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে দ্য ইকোনমিস্ট।

গণহত্যার ২৫ বছর পার হয়ে গেলেও রুয়ান্ডা এখনো একটি ধাঁধা হয়েই রয়েছে। দেশটির সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি রয়েছে অনেক প্রশ্ন। শুধু বর্তমান নয়, অতীত নিয়েও রয়েছে বহু প্রশ্ন। গণহত্যায় ঠিক কত মানুষ মারা গিয়েছিল? বাইরের কোনো শক্তি, বিশেষ করে জাতিসংঘ কি চাইলে এই গণহত্যা আটকাতে পারত?

তবে বর্তমানে এগুলোর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দিয়েছে অন্য কিছু প্রশ্ন। রুয়ান্ডা কি তার ২৫ বছর আগের সেই ক্ষত ভুলতে পেরেছে? গণহত্যার পরপরই ক্ষমতায় আসা পল কাগামে কি রুয়ান্ডাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আনতে পেরেছেন? না কি ভয়ানক সেই স্মৃতির ফায়দা তুলে নিজের একনায়কতন্ত্রকে জায়েজ করতে চাইছেন তিনি? কাগামে দেশটির সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তুতসির অন্তর্ভুক্ত। ২৫ বছর আগে যাদের হাতে মারা গিয়েছিল অজস্র তুতসি, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতুরা কি আবারও ক্ষমতায় আসার জন্য সংঘবদ্ধ হচ্ছে? রুয়ান্ডায় কি আদৌ গণতন্ত্র ফিরবে?

মাত্র ১০০ দিন চলা সেই গণহত্যায় প্রাণ গিয়েছিল ৮ লাখ মানুষের, যার চার ভাগের তিন ভাগই ছিল তুতসি জনগোষ্ঠীর। নিহতের সংখ্যা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। জাতিসংঘের ধারণা নিহতের সংখ্যা ৮ লাখ। কাগামের ভাষ্যমতে, এই সংখ্যা ১০ লাখ। অ্যালিসন ডে ফরজেস নামের এক মানবাধিকারকর্মী আবার ৫ লাখ মানুষের মারা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায় বলে উল্লেখ করেন।

গণহত্যায় নির্বিচারে তুতসিদের হত্যা করেছিলেন হুতুরা। হুতু স্বামী তাঁর তুতসি স্ত্রীকে হত্যা করেছেন, হুতু ধর্মযাজকেরা সরাসরি তুতসিদের হত্যা করার ব্যাপারে প্ররোচনা দিয়েছেন। হুতুদের মনে তুতসিদের সম্পর্কে ঘৃণার বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল বেশ ভালোভাবেই।

এই গণহত্যার কোনো স্বীকৃত বিচার পায়নি রুয়ান্ডা। ২০০২ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ১০ বছরে অসংখ্য স্থানীয় আদালত বসিয়ে প্রথাগত উপায়ে বিচারের ব্যবস্থা করা হতো। স্থানীয় ভাষায় এই আদালতগুলোকে বলা হয় ‘গাচাচা’। ব্রিটিশ অধ্যাপক নিক জনসন বলেছেন, ‘এই গাচাচার বিচার ব্যবস্থা নির্ভুল ছিল, এমন দাবি কোনো রুয়ান্ডারই কোনো মানুষ করবে না। কিন্তু এই আদালতগুলো যে রুয়ান্ডাকে রক্ষা করেছে, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।’ পল কাগামের দাবি, গত ২৫ বছরে রুয়ান্ডায় কোনো বড় আকারের সহিংস ঘটনা ঘটেনি।

রুয়ান্ডা


অবস্থান: আফ্রিকা মহাদেশ
প্রতিবেশী: উগান্ডা, বুরুন্ডি, তানজানিয়া, কঙ্গো
রাজধানী: কিগালি
আয়তন: ২৬,৩৩৮ বর্গ কিলোমিটার
জনসংখ্যা: এক কোটি ১২ লাখ (২০১৫)
ভাষা: কিনারান্ডা, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ
মুদ্রা: রুয়ান্ডান ফ্রাঁ
সূত্র: বিবিসি

কিন্তু তাই বলে কি শান্তিতে আছে রুয়ান্ডার জনগণ? ব্রিটিশ গবেষক ফিল ক্লার্ক গত ১৬ বছর ধরে এক হাজারেরও বেশি হুতু ও তুতসির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এঁরা বলছেন, রুয়ান্ডায় এখন শান্তি আছে বটে, কিন্তু দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক এখনো আগের মতোই অস্বস্তিকর।

তবে রুয়ান্ডার এই স্থিতিশীলতা কিন্তু এমনি এমনিই আসেনি। শান্তি ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য নিজেদের রাজনৈতিক ও বাকস্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয়েছে রুয়ান্ডার জনগণকে। দেশটির অর্থনীতি এখন উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯৫ সালে দেশটিতে মাথাপিছু আয় যেখানে ছিল ১২৫ ডলার, সেটি এখন ৮০০ ডলারে উঠে এসেছে। ২০০০ সালের পর দেশটিতে শিশু মৃত্যুর হার প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। কিন্তু এসব উন্নয়নের জন্য নিজেদের রাজনৈতিক মতপ্রকাশের অধিকার বলি দিতে হয়েছে রুয়ান্ডাবাসীকে। সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত হওয়ার সাহস রুয়ান্ডার খুব কম মানুষেরই রয়েছে। একজন রুয়ান্ডান সাংবাদিক বলেছেন, ‘আপনি এমন একজনকেও খুঁজে পাবেন না, যিনি মনের ভাবনাকে মুখে বলার সাহস রাখেন।’ আগের তুলনায় নিয়ন্ত্রণ কিছুটা কমিয়ে এনেছেন কাগামি, কিন্তু দেশটির রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের বিন্দুমাত্র কোনো সুযোগ নেই। ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত সবশেষ নির্বাচনে ৯৯% ভোট পেয়েছেন কাগামে। এ থেকেই বোঝা যায় দেশটিতে গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা কেমন।

১০০ দিনের গণহত্যায় এভাবেই প্রাণ গিয়েছিল ৮ লাখ মানুষের। ছবি: রয়টার্স
১০০ দিনের গণহত্যায় এভাবেই প্রাণ গিয়েছিল ৮ লাখ মানুষের। ছবি: রয়টার্স

শুরুর দিকে বলা হয়েছিল, প্রতিবেশী দেশ কঙ্গোর জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা অপরাধীদের খুঁজে বের করতে সেনা সদস্যদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো, রুয়ান্ডার সেনাবাহিনী কঙ্গোতে গিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে এবং কঙ্গো থেকে খনিজ সম্পদ লুট করে নিয়ে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বন্ধুরাষ্ট্র উগান্ডার সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ হয়েছে কাগামের। রুয়ান্ডার ‘দেশদ্রোহীদের’ আশ্রয় দিচ্ছে উগান্ডা, এমন অভিযোগ এনে উগান্ডার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করছেন কাগামে।

কাগামের সমর্থকদের দাবি, একমাত্র তাদের নেতাই পারেন ভঙ্গুর এই রুয়ান্ডাকে অক্ষত রাখতে। কিন্তু প্রতি বছরই এমন ধারণা নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের সামনে পড়ছে। ২৫ বছর ক্ষমতায় কাটিয়ে দেওয়ার পর কাগামে তাই এখন দুটি পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর প্রথম চ্যালেঞ্জ, কোনো উত্তরসূরির হাতে ক্ষমতা সুষ্ঠুভাবে হস্তান্তর করা। আর দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ, তিনি ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পরে রুয়ান্ডায় যেন আবার সেই সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে, সেটি নিশ্চিত করা। তবে আরও একটি বাধার সামনেও পড়তে পারেন তিনি। এই একনায়কতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা রুয়ান্ডার জনগণ আর কত দিন মেনে নেবেন, না কি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করবেন, সেটিই এখন দেখার বিষয়।