প্রার্থীর চেয়ে ভোটারই বেশি ব্যাকুল

উৎফুল্ল সমর্থকদের সঙ্গে সেলফি তুলছেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। ইন্দোনেশিয়া, ২৪ মার্চ। ছবি: রয়টার্স
উৎফুল্ল সমর্থকদের সঙ্গে সেলফি তুলছেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। ইন্দোনেশিয়া, ২৪ মার্চ। ছবি: রয়টার্স

ইন্দোনেশিয়ার মাঝারি আকারের শহর জোগিকার্তা। শহরের সরু গলি ধরে ধাতব প্যাভিলিয়নের পাশ দিয়ে জনতার কাছে যাওয়ার পথ করে নিচ্ছেন তুতিয়েক উইদো। ছোট একটি ইসলামিক দল ন্যাশনাল ম্যান্ডেট পার্টির (প্যান) পক্ষ থেকে স্থানীয় আইন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী তিনি। ১৭ এপ্রিল হবে এই নির্বাচন।

রত্নখচিত হিজাব পরা তুতিয়েক অবিচলভাবে নিজের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন জনসাধারণকে, যাঁদের অধিকাংশই প্রবীণ। মাথা নেড়ে, স্মিত হেসে তুতিয়েকের কথায় সাড়া দিলেও তাঁদের মন পড়ে রয়েছে অন্যদিকে। প্রচারণার অংশ হিসেবে বিনা মূল্যে চা আর ‘গুদেগ’ বলে পরিচিত ইন্দোনেশীয় কাঁঠালের বিশেষ রসাল খাবার।

প্যানের শক্তিশালী ঘাঁটি জোগিকার্তা। তার জন্য আংশিক দায় সংযুক্ত মুসলিম সংগঠন মুহাম্মাদিয়ার। জোগিকার্তায়ই তাদের সদর দপ্তর। তবু জনগণের সমর্থন আদায় করতে নিজ যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে যতটা সম্ভব তাদের ভরসা অর্জন করতে হবে তুতিয়েকের। নির্বাচনী আইনে সম্প্রতি কিছু পরিবর্তন এসেছে। বর্তমান আইন অনুযায়ী, জাতীয় সংসদে আসন পেতে হলে অন্তত ৪ শতাংশ জনগণের ভোট পেতে হবে প্রতিটি দলের। ২০০৪ সালের তুলনায় এবার অন্তত দ্বিগুণ ভোটের প্রয়োজন হবে।

জরিপে দেখা গেছে, প্যানের অবস্থান তেমন ভালো নয়। একেবারে প্রান্তে। চেক কাপড়ের সারং পরা অবসরপ্রাপ্ত দরজি আবদুলজালি বলেন, তিনি প্যানের সমর্থক। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতি নির্বাচনে তিনি প্যানের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। প্যান সংসদে যেতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও অন্য কাউকে ভোট দেবেন না আবদুলজালি।

ঝুঁকিতে রয়েছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলও। সংসদের ১০টি দলের মধ্যে ৪টিই ৪ শতাংশ ভোটের কোটা পূরণ করতে পারবে না। অন্য ২টি দল কোনোমতে বিপৎসীমা উতরে গেছে বলে সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে। বিদায়ের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো দলগুলোর এই অবস্থার পেছনে মূলত দায়ী গত কয়েক বছরের শাসন, যার কারণে নির্বাচনে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব অনেকাংশে কমে গেছে।

গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে এখনো শৈশব পার করছে ইন্দোনেশিয়া। ১৯৪৫ সালে নেদারল্যান্ডসের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্প সময়ের জন্য প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হয়। এরপরই দেশটিকে গ্রাস করে ফেলে চার দশকের স্বৈরাচারী শাসন। শুরুতে সুকর্ণ ও পরে সুহার্তোর হাত ধরে চলে এই শাসন। দ্বিতীয়জন অর্থাৎ সুহার্তো সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেও তাঁর বিরোধী দলের প্রার্থীরা ছিলেন আতঙ্কিত। কাজেই দুটি দলকে জোর করে নির্বাচনে হাজির করে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন করলে আর যা-ই হোক গণতন্ত্র যে প্রতিষ্ঠিত হয় না, তা বলাই বাহুল্য। নমনীয় সাংসদেরা সেবার এক সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন। গণ-আন্দোলনের তোপে পড়ে ১৯৯৮ সালে সুহার্তো পদত্যাগ করলে দেশটি পুনরায় উন্মুক্ত নির্বাচন পদ্ধতিতে ফিরে যায়।

তারপর থেকে ঘটনাচক্রে ধীরে ধীরে দেশটিতে গণতন্ত্র বিকশিত হতে থাকে। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনগুলো সত্যিকার অর্থে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠে। সরকারের প্রতিটি স্তরে অনুপ্রবেশ করে গণতন্ত্র। ভোটারদের বেছে নিতে হয় একজন প্রধান নির্বাহী এবং একটি সংসদ। আর সেটা কেবল পুরো দেশের জন্য সামগ্রিক একটি ব্যবস্থা নয়, প্রতিটি প্রদেশ এবং প্রশাসনের পরবর্তী ধাপ—শহর এবং জেলার জন্যও অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। গণমাধ্যম এখানে স্বাধীন, আন্দোলনের চিত্র খুবই সাধারণ ঘটনা।

তবে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা ঘিরে ভোটারদের মধ্যে যতটা উৎসাহ কাজ করছে, রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে ততটা উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে না। ক্ষমতাধর দলগুলো এমন এক ফন্দি আঁটছে, যাতে পুরোনো দলগুলোর টিকে থাকাই শুধু মুশকিল হয়ে পড়ছে না, বরং নতুনদের আরও কৌশলীও হতে হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে যখন নতুন নির্বাচনী আইন অনুমোদন পায়, সরকার তখন আচেহ, পূর্ব তিমুর এবং পাপুয়া অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে লড়ছে। নতুন নিয়মে বিচ্ছিন্নবাদীদের কোণঠাসা করতে জাতীয় দলগুলোকে বেশি করে কর্মকর্তা নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দেশটির অন্তত অর্ধেক প্রদেশ এবং অর্ধেক জেলায় নিয়োগ করতে হবে জাতীয় দলের কর্মকর্তাদের। অপসারণের ভয় কমে গেলেও নতুন দলগুলোর প্রতি বাধার কোনো কমতি নেই। এখন সব প্রদেশে, তিন-চতুর্থাংশ জেলায় এবং অর্ধেকের মতো উপজেলায় অংশ নিতে হবে দলগুলোর।

নেওয়ার সুযোগ কম
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে ভোটারদের হাতে খুব বেশি বিকল্প নেই। ২০০৪ সালের কথা, গণতান্ত্রিক যুগ তখন মাত্র শুরু হচ্ছে। সেই আমলে প্রথম প্রত্যক্ষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যালট পেপারে প্রার্থী ছিলেন পাঁচজন। অথচ এ বছর ভোটারদের মাত্র দুজন প্রার্থীর মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নিতে হবে। 

গতবারের নির্বাচনে অর্থাৎ ২০১৪ সালে ক্ষমতাসীন জোকো উইডোডো বা জোকোয়ি মুখোমুখি হন তিন-তারকাধারী জেনারেল প্রাবোয়ো সুবিয়ান্তোর। প্রতিযোগীর সংখ্যা কমানোর জন্য প্রাণপণে কাজ করে গেছেন জোকোয়ি। প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের অন্তত ২০ শতাংশ সাংসদের সমর্থন থাকতে হবে—২০১৭ সালে জোকোয়ির জোট সরকার এই আইন বাতিলের দাবি নাকচ করে দেয়। জোট সরকার গঠনের পর থেকে এখনো পর্যন্ত সংসদে ৬০ শতাংশ আসন তারাই দখল করে আছে। এই আইন বলবৎ থাকলে জোকোয়ির প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন কেবল একজন। বিরোধী দলগুলো এবং জোকোয়ির তৎকালীন জোট অংশীদারেরা আইনটি কার্যকর করার দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।

নির্বাচন আরও প্রতিযোগিতাহীন হয়ে উঠতে পারে। আগের নির্বাচনে দুজন দুজনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া সত্ত্বেও এক বছর আগে জোকোয়ি ও প্রাবোয়োর সম্পর্ক সম্পূর্ণ নতুন মোড় নেয়। এবারের নির্বাচনে এক টিকিটে দুই সঙ্গী মাঠে নামতে পারেন—এমন কথা ছড়িয়ে পড়েছে ইন্দোনেশিয়ার আকাশ-বাতাসে। যদি তা-ই হয়, তবে অর্থপূর্ণ একটি নির্বাচনের সব সম্ভাবনাই শেষ হয়ে যাবে। এ নিয়ে প্রচুর কথা হচ্ছে, তবে পর্যবেক্ষকদের দাবি সম্ভাব্য এই বন্ধুতা দেশটির গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার মতো বিধ্বংসীও হতে পারে।

জরিপে ভোটারদের হতাশা প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। ২০০৪ সাল থেকে প্রতি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা কমেছে। এই উদ্বেগের প্রকাশ ঘটছে অনলাইনেও। জানুয়ারি মাসে নুরহাদি এবং অল্ডোর প্রচারণা সামগ্রী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্টের টিকিট পাওয়ার জন্য ভুয়া হলেও তা ছিল বিশ্বাসযোগ্য। ফাঁকফোকরে ভরা ইন্টারনেটের আবিষ্কার, ধার্মিক ভঙ্গিতে পোজ দেওয়া গোঁফওয়ালা এক লোকের ছবি এবং সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোকে বিনা কারণেই বিজয়ী ঘোষণা করা—এই মিথ্যা গল্প থেকে নুরহাদি আর অল্ডো মিলে সৃষ্টি হয় হাস্যকর এক ডাকনাম ‘ডিলডো’।

খুব সম্ভবত ভোটারদের পছন্দের সবচেয়ে গুরুতর ক্ষয় সাধিত হবে প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে। গত বছর এসব অঞ্চলের ভোটারদের ৯ শতাংশের সামনে ছিল একজন মাত্র প্রার্থী, ২০১৫ সালের হিসাবে এই ভোটারের হার ছিল ১ শতাংশ। ২০১৪ সালে সাংবিধানিক আদালতে একক প্রার্থিতার প্র্যাকটিসটি বৈধ অনুমোদন পায়। দোদুল্যমান জোট, ক্ষেত্রবিশেষে যেখানে সব দলই এক জোট হয়ে পড়ে, সেখানে এমন ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। রাজনৈতিক লুটের মাল সুষমভাবে ভাগ-বাঁটোয়ারা করা হয়। কাজেই খামোখা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে টাকা নষ্ট করা এ দেশে অর্থহীন। এমনকি জোটে থাকা প্রার্থীরাই যে জিতবেন এমন কোনো কথা নেই। গত বছর পূর্বাঞ্চলের শহর মাসাকারে মেয়র নির্বাচনে শূন্য ভোটে হেরে যান এক প্রার্থী। ধারণা করা হচ্ছে, নিজেদের মতো করে ক্ষোভ প্রকাশের একটি উপায় বের করে নিয়েছে ইন্দোনেশিয়াবাসীরা।