আশঙ্কিত মায়াবতী, শঙ্কিত মোদি

নরেন্দ্র মোদি ও  মায়াবতী
নরেন্দ্র মোদি ও মায়াবতী

উঠতে–বসতে মায়াবতী কেন কংগ্রেসকে গাল পাড়ছেন, কেনইবা মুসলমানদের বলছেন, একটা ভোটও কংগ্রেসকে দিয়ে বিজেপিকে সাহায্য করবেন না—উত্তর প্রদেশ না গেলে বুঝতাম না। ভারতের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের প্রথম পর্বের ভোটে উত্তর প্রদেশের পশ্চিম প্রান্তের ৮টি কেন্দ্র আজ বৃহস্পতিবার বুঝিয়ে দেবে, নরেন্দ্র মোদি না মায়াবতী, কার আশঙ্কা এবার সত্যি হবে।

দুজনের আশঙ্কা দুই ধরনের। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আশঙ্কা, উত্তর প্রদেশে জোটের তোড়ে এবার না তাঁকে ভেসে যেতে হয়। মায়াবতীর আশঙ্কা আবার যে দলকে বিন্দুমাত্র কল্কে দিলেন না, জোটে নিলেন না, সেই কংগ্রেসকে নিয়ে। ভয়, শতাব্দীপ্রাচীন দলটা না এবার তাঁর এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দাঁড়ি টেনে দেয়। কার আশঙ্কা বড় হয়ে দেখা দেবে, পশ্চিম উত্তর প্রদেশের ভোটাররা সেই উত্তরটাই আজ দিয়ে রাখছেন। আজকের ভোট সেই অর্থে ‘মিনি ইন্ডিয়া’ উত্তর প্রদেশের হাঁড়ির ভাত।

৪২ দিন পর ২৩ মে ফল বেরোলে আরও বোঝা যাবে, কংগ্রেসের ওপর মায়াবতীর রা গ কতটা সংগত। কেন তিনি এভাবে কংগ্রেসকে প্রকাশ্যে গালমন্দ করছেন। পাশাপাশি এও বোঝা যাবে, বিজেপির বিরুদ্ধে ঠিক প্রার্থী বেছে নিতে রাজ্যের মুসলমান ঠিক না ভুল, কোনটা করল এবং রাজ্যে মোদি-ম্যাজিকের মূর্ছনা কতখানি অবশিষ্ট।

বিজেপির বিরুদ্ধে মহাজোটে শামিল না হওয়ার জন্য মায়াবতী ও রাহুল গান্ধী দুজনেই দুই দলের ‘ঔদ্ধত্য ও গোঁয়ার্তুমি’কে দায়ী করেছেন। সত্য হলো, কমবেশি দুই দলই ঠিক। উত্তর প্রদেশে মহাজোট গঠনের আগে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে দুর্বল মায়াবতী এক–চতুর্থাংশ দাবিতে অনড় ছিলেন। আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার আগেই ক্ষুব্ধ মায়াবতী ছত্তিশগড়ে সাবেক কংগ্রেস নেতা অজিত যোগীর দলের সঙ্গে জোট বাঁধার কথা ঘোষণা করে দেন। উত্তর প্রদেশে কংগ্রেসের দাবি ছিল ১০টা আসন। কিন্তু আমেথি ও রায়বেরিলির বাইরে তৃতীয় কোনো আসন না দেওয়ার গোঁ ছাড়তে মায়াবতী রাজি ছিলেন না। ফলে, যা হওয়ার সেটাই হয়েছে। যে লড়াই দ্বিমুখী হয়ে বিজেপির কফিনের শেষ পেরেক হতে পারত, তা ত্রিমুখী হয়ে তাদের হাঁফ ছাড়ার ফুরসত করে দিল।

উত্তর প্রদেশের যে আসনগুলোয় আজ ভোট, সেগুলোয় মুসলমান জনসংখ্যা রাজ্যের গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। উত্তর প্রদেশে মুসলমান জনসংখ্যা ২০ শতাংশের মতো। সেই তুলনায় গাজিয়াবাদের মুসলমান জনসংখ্যা সাড়ে ২৫ শতাংশ, বাগপতের ২৮ শতাংশ, মীরাটে সাড়ে ৩৪, মুজাফফরনগরে ৪১ শতাংশ, সাহারানপুরে ৪২, বিজনৌরে ৪৩ শতাংশ। মোরাদাবাদ ও রামপুর জেলা পশ্চিম প্রান্তে নয়। কিন্তু মুসলমান জনসংখ্যা সেখানে যথাক্রমে ৪৭ ও সাড়ে ৫০ শতাংশ। এসব কেন্দ্রের কোথাও কোথাও জোট ও বিজেপিকে হারিয়ে কংগ্রেস জেতার জন্য ঝাঁপিয়েছে, কোথাও লড়ছে জোটকে সাহায্য করতে। যেমন সাহারানপুর। এই কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থী ইমরান মাসুদ গতবার চার লাখ ভোট পেয়ে বিজেপির কাছে হেরেছিলেন মাত্র ৬৫ হাজারের ব্যবধানে। সেবার এসপি, বিএসপি ও আরএলডির সম্মিলিত ভোট ছিল ইমরানের চেয়ে কম। এই আসনের জন্য কংগ্রেসের দাবি মায়াবতী মানেননি। তাঁর দলের হাজি ফজলুর রহমানকে জোট প্রার্থী করল। কেন্দ্র ঘুরে মনে হয়েছে, মুসলমান মন শেষ মুহূর্তে হয়তো ইমরানকেই আঁকড়ে ধরতে চলেছে।

উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস এবারের ভোটটা নানা কৌশলে লড়ছে। জোট প্রার্থী দিয়েছে—এমন নয়টি কেন্দ্রে কংগ্রেস এবার লড়ছে না। যেমন: বাগপত, মুজাফফরনগর। সমাজবাদী পার্টির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দুর্বল প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে। যেমন: মোরাদাবাদ কিংবা রামপুর। রামপুরের জোট প্রার্থী সমাজবাদী পার্টির আজম খান। তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপি প্রার্থী অভিনেত্রী জয়া প্রদা। কংগ্রেস দাঁড় করিয়েছে উচ্চবর্ণের হিন্দু সঞ্জয় কাপুরকে। লক্ষ্য, হিন্দু ভোটে ভাগ বসিয়ে জয়া প্রদার রাস্তায় কাঁটা ফেলে আজম খানকে জেতানো। বিজনৌরে কংগ্রেস টিকিট দিয়েছে বিএসপি ছেড়ে আসা নাসিমুদ্দিন সিদ্দিকীকে। মায়াবতীর ধারণা হয়েছে, রাজ্যে পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে কংগ্রেস যে কৌশল নিয়েছে, তাতে প্রাথমিকভাবে বেশি ক্ষতি তাঁর। কংগ্রেসকে গালমন্দ না করে মায়াবতী তাই অন্ন গ্রহণ করছেন না।

মায়াবতীর আশঙ্কা একেবারে অমূলকও নয়। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে যোগ দেন, রাহুল সেদিন বলেছিলেন, উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস ‘ফ্রন্ট ফুটে’ খেলতে নেমেছে। টি-টোয়েন্টি নয়, কংগ্রেসের নজরে টেস্ট ম্যাচ। ‘লম্বা রেসের ঘোড়া’ প্রিয়াঙ্কাকে সামনে এনে রাহুল নজর দেন দলিত সমাজের প্রতি। বারানসি দিয়ে শুরু হয় প্রিয়াঙ্কার প্রচার। টানা তিন দিন তিনি কাটালেন দলিত সমাজে। এই সমাজের চোখের মণি এত দিন ধরে একজনই—মায়াবতী। গত ভোটে এই সমাজকে বিভক্ত করে বিজেপি কেল্লা ফতে করেছিল। মায়াবতীর কাছে প্রিয়াঙ্কা নতুন বিপদ।

রাহুল-প্রিয়াঙ্কার ওপর মায়াবতীর রাগের অন্য কারণ তরুণ দলিত ‘আইকন’ চন্দ্রশেখর আজাদ রাবণকে কাছে টানা। ‘ভিমসেনা’র প্রতিষ্ঠাতা এই রাবণের নামে ইদানীং আন্দোলিত হচ্ছে যুব দলিত মন। অসুস্থ রাবণকে দেখতে মীরাটের হাসপাতালে যান প্রিয়াঙ্কা। এই ভোটে ভিমসেনা বিভিন্ন কেন্দ্রে কংগ্রেসকে প্রকাশ্যে সমর্থনও করছে। রাবণের কথায়, বিজেপি প্রধান শত্রু, মায়াবতীর চোখে রাবণ বিজেপির ‘বি টিম’। রাহুল-প্রিয়াঙ্কা এখন সেই রাবণের কাছের মানুষ। কংগ্রেসের ওপর মায়াবতীর রাগের কারণ না বোঝার তাই কোনো কারণ নেই।

উত্তর প্রদেশের আজকের ভোট সেই অর্থে অনেক কিছুরই ইঙ্গিতবাহী হতে চলেছে। মোদি-ম্যাজিক অটুট আছে কি না, মহাজোট কার্যকর হচ্ছে কি না, মুসলমান সম্প্রদায় বিজেপির বিরুদ্ধে ঠিক প্রার্থী বাছাই করতে ভুল করছে কি না, ‘ফ্রন্ট ফুটে’ খেলা কংগ্রেস পায়ের তলার জমি শক্ত করতে পারছে কি না, দ্রষ্টব্য বহুবিধ। রাহুল-প্রিয়াঙ্কা সরাসরি বলছেন, তাঁদের নিকট লক্ষ্য ২০১৯-এ মোদির পরাজয়। পরের লক্ষ্য ২০২২ সালে উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় আসা।

মায়াবতী ও মোদি আশঙ্কিত দুজনেই। কার বেশি কার কম, আজ তার প্রথম ললাটলিখন।