নিজেকে বাঁচাতে পারবেন অ্যাসাঞ্জ?

ব্রিটেনে গ্রেপ্তার হয়েছেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, তবে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ছবি: রয়টার্স।
ব্রিটেনে গ্রেপ্তার হয়েছেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, তবে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ছবি: রয়টার্স।

বৃহস্পতিবার সকালে আমেরিকানদের ঘুম ভেঙেছে উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর শুনে। দীর্ঘ সাত বছর লন্ডনে ইকুয়েডর দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকার পর অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার করল ব্রিটেন।

তবে এই গ্রেপ্তার নাটক ছাড়িয়েও বড় হয়ে উঠেছে আরেকটি প্রশ্ন। ব্রিটেনের পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার হলেও অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রত্যর্পণ করা হবে কি না, এটিই এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। ওয়াশিংটনের পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্লেষকদের ধারণা, অ্যাসাঞ্জকে দিন শেষে আমেরিকার কাছেই প্রত্যর্পণ করা হবে। তবে সেটি কবে নাগাদ, সে বিষয়ে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।

সুইডেনে এক নারীকে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ মাথায় নিয়ে যুক্তরাজ্যে এসে সেখানেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন অ্যাসাঞ্জ। কিন্তু ২০১২ সালে জামিনে মুক্ত হয়ে লন্ডনে ইকুয়েডর দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন তিনি। মূলত ইকুয়েডরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরেয়ার উদ্যোগেই তাঁকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। সুইডেন তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিলেও শেষ রক্ষা হয়নি অ্যাসাঞ্জের। ব্রিটিশ আদালতের জামিনের শর্ত লঙ্ঘনের দায়ে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানার জের ধরে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে।

তবে অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের প্রশ্ন উঠেছে ২০১৬ সালে আমেরিকায় নির্বাচনের আগে তথ্য ফাঁসজনিত ঘটনায়। চেলসি ম্যানিংয়ের সঙ্গে মিলে আমেরিকার অনেক গোপন তথ্য ফাঁস করে বিশ্ব মিডিয়ায় শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন অ্যাসাঞ্জ। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, গোপন নথিপত্র ফাঁস করার জন্য নয়, বরং হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে তথ্যভাণ্ডারে ঢোকাকেই অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

এদিকে গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে গোপনে মামলা প্রস্তুত করার বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়। তখন থেকেই আভাস পাওয়া যাচ্ছিল, গ্রেপ্তার হতে পারেন অ্যাসাঞ্জ, এবং তাঁকে আমেরিকার কাছেই প্রত্যর্পণ করা হবে।

কিন্তু অ্যাসাঞ্জের কি নিজেকে বাঁচানোর কোনই উপায় নেই? আমেরিকা ও ব্রিটেনের মধ্যে প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ এরিক লুইস বলছেন, নিজেকে রক্ষা করার সম্ভাব্য চারটি উপায় রয়েছে অ্যাসাঞ্জের সামনে। ওয়াশিংটনের পোস্টের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেই চারটি উপায়।

(১) দ্বৈত অপরাধ: প্রত্যর্পণের অন্যতম একটি শর্ত হলো, যে অপরাধের কারণে বন্দী ব্যক্তিকে অপরাধী বলা হচ্ছে, সেটি দুই দেশের আইনেই স্বীকৃত অপরাধ হতে হবে। অর্থাৎ তথ্য ফাঁসের উদ্দেশে অনুপ্রবেশ করা যে ব্রিটিশ আইনেও অপরাধ, অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রত্যর্পণ করতে হলে সেটি আগে প্রমাণিত হতে হবে।

(২) ব্রিটেনের ‘উদারতা’: অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের যেই অভিযোগ, সেটিই কি একমাত্র অভিযোগ হয়ে থাকবে? না কি নতুন করে আরও কোনো অভিযোগ আনা হবে? গুঞ্জন আছে, সংবেদনশীল তথ্য ফাঁসের দায়ে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে সামনে নতুন অভিযোগ দায়ের করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তবে ব্রিটিশ সরকার যদি নতুন অভিযোগের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলার মতো ‘উদারতা’ দেখায়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অ্যাসাঞ্জের নামে নতুন মামলা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

(৩) রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার: রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার হচ্ছেন, এমন অভিযোগ এনে অ্যাসাঞ্জ মুক্তি প্রার্থনা করতে পারবেন কি না, সে বিষয়েও আলোচনা হচ্ছে। রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার হওয়ার নজির যে একেবারে নেই তাও কিন্তু নয়। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ানের প্রতিপক্ষ ফেতুল্লাহ গুলেনকে রাজনৈতিক আক্রোশের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়েছিল তুরস্ক।

(৪) মতপ্রকাশের স্বাধীনতা: একজন সাংবাদিক হিসেবে কেবল নিজের কাজ করছিলেন, এবং মতপ্রকাশের জন্য তাঁকে অপরাধী বানানো উচিত নয়, এমন দাবি তুলেও নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারেন অ্যাসাঞ্জ।

লুইসের মতে, শেষের বিষয়টি নিয়েই ঝামেলা বাঁধতে পারে অ্যাসাঞ্জ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। তবে সেই ঝামেলার সমাধানে পৌঁছাতে ‘বছরের পর বছর’ ও লাগতে পারে। লুইস বলছেন, ‘যদি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতায়ও আসে, তবুও যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন জানানোর অধিকার অ্যাসাঞ্জের রয়েছে।’

তবে যুক্তরাষ্ট্র কি পদক্ষেপ নেবে সেটি অস্পষ্ট হলেও ব্রিটেনের আইন অনুযায়ী যে অ্যাসাঞ্জকে শাস্তি পেতে হবে, সেটি একপ্রকার নিশ্চিত। জামিন লঙ্ঘনের অপরাধে এক বছরের কারাদণ্ডও পেতে হতে পারে তাঁকে। অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীরা অবশ্য তাঁর জামিনের পক্ষে আবেদন করতে পারবেন, তবে এরই মধ্যে একবার জামিন লঙ্ঘন করে ফেলায় পুনরায় তাঁর জামিন পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।