টোকিও অলিম্পিকে কেলেঙ্কারির বিড়ম্বনা

টোকিওতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার বাকি আছে কম-বেশি ১৫ মাস। ফলে অলিম্পিকের প্রস্তুতি এখন বলা যায় পুরোদমে এগিয়ে চলছে। মূল অলিম্পিক স্টেডিয়াম, অলিম্পিক ভিলেজ ও সেই সঙ্গে অন্যান্য ভেন্যুর নির্মাণকাজ ইতিমধ্যে পূর্ণ গতি পেয়েছে। ফলে সময়মতো সব রকম প্রস্তুতি শেষ হয়ে যাওয়া নিয়ে উদ্যোক্তারা আশাবাদী। তবে তা সত্ত্বেও বিতর্ক আর কেলেঙ্কারি যেন টোকিও ২০২০ অলিম্পিকের পেছনে লেগেই আছে, যার সূচনা হয়েছিল বছর কয়েক আগে নতুন অলিম্পিক স্টেডিয়ামের জন্য অনুমোদিত নকশা সব কিছু চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পরও সেটা বাতিল হয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে।

২০২০ অলিম্পিকের স্বাগতিক শহর হতে পারার হওয়ার প্রতিযোগিতায় টোকিও জিতে যাওয়ার ঠিক পরপর অলিম্পিক কমিটি ১৯৬৪ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের জন্য নির্মিত জাতীয় স্টেডিয়াম ভেঙে সেখানে নতুন একটি স্টেডিয়াম তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই অনুযায়ী নতুন একটি স্টেডিয়ামের নকশার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা আহ্বান করলে ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ স্থপতি জাহা হাদিদের জমা দেওয়া নকশাটি শুরুতে অনুমোদিত হয়। তবে নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার অল্প আগে খরচ বেড়ে যাওয়ার অজুহাত দিয়ে টোকিও অলিম্পিক কমিটি অনুমোদিত সেই নকশা বাতিল করে দিয়ে নতুন করে আবারও প্রতিযোগিতার আহ্বান করে। আর এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। জাহা হাদিদ নিজে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে অলিম্পিক কমিটিকে এ কারণে ভাগ্যবান বলতে হয় যে জাহা হাদিদের হঠাৎ মৃত্যুতে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। আর নতুনভাবে বাছাই করা নকশা অনুযায়ী অলিম্পিক স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজও সময়মতো শুরু হয়।


পরবর্তী কেলেঙ্কারিটি অলিম্পিকের লোগোর সঙ্গে জড়িত। এই ক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে লোগো বেছে নেওয়ার কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর টোকিও অলিম্পিক কমিটি সেই লোগো উন্মোচন করার পর দেখা যায় সেটা আঁকা হয়েছে বেলজিয়ামের রাজধানীর একটি থিয়েটার হলের লোগোর অনুকরণে। লোগোর নকশা আঁকা শিল্পী হয়তো ধরে নিয়ে থাকবেন অজানা এক থিয়েটার হলের লোগোর কথা কারও জানা না থাকায় নকল করার বিষয়টি ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা নেই। তবে লোগো উন্মোচিত হওয়ার অল্প কিছুদিন পরেই সংবাদমাধ্যম বিষয়টি নিয়ে হইচই শুরু করে দেয়। ফলে আয়োজক কমিটি এই লোগো বাতিল ঘোষণা করে এবং লোগোর জন্য নতুন করে আবারও প্রতিযোগিতা আহ্বান করে। সেখান থেকে বেছে নেওয়া হয় নতুন লোগো।


২০২০ অলিম্পিকের প্রস্তুতি গ্রহণের প্রাথমিক পর্যায়ের সেই দুই কেলেঙ্কারির পর গত কয়েক বছরে টোকিও অলিম্পিক কমিটিকে তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। কিছু কিছু নির্মাণকাজ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলেও কেলেঙ্কারির পর্যায়ে তা গড়ায়নি। তবে চলতি বছরের শুরু থেকে আবারও নতুন কিছু সমস্যা দেখা দেওয়ার অলিম্পিক কমিটিকে এখন সেই সব ধাক্কা সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।


এ বছরের প্রথম কেলেঙ্কারির সূচনা ২০২০ অলিম্পিকের স্বাগতিক শহর হতে পারার প্রচেষ্টায় টোকিওর অসৎ পন্থা অবলম্বনে ফ্রান্সের উত্থাপিত অভিযোগ থেকে। ফরাসি কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, ২০২০ সালের অলিম্পিক প্রতিযোগিতা টোকিওকে পাইয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় টাকা-পয়সার লেনদেন হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ তাদের হাতে আছে। এ অভিযোগ জাপান অলিম্পিক কমিটির সভাপতির সুনে-কাজু তাকেদার বিরুদ্ধে ফ্রান্সের কৌঁসুলিরা তদন্ত শুরু করেছেন।


জাপান অলিম্পিক কমিটি শুরুতে এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বললেও পরবর্তী সময়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে সিঙ্গাপুরের একটি পরামর্শক কোম্পানিকে ২০১৩ সালে ২০ লাখ মার্কিন ডলার পরিশোধের প্রমাণ তুলে ধরা হয়। তখন অলিম্পিক কমিটি বলতে বাধ্য হয়েছিল যে বৈধ পরামর্শক ফি হিসেবেই সেই অর্থ কোম্পানিকে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ব্ল্যাক টাইডিংস নামের সেই কোম্পানির পরিচালকদের একজন ছিলেন আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সেই সময়ের সেনেগালি এক প্রভাবশালী সদস্যের পুত্র পাপা মাসাতা ডিয়াক। জাপান অলিম্পিক কমিটি অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে যাওয়ার মুখে গত মাসে তাকেদা হঠাৎ করে ঘোষণা দেন, জুনে বর্তমান মেয়াদ শেষ হলে দায়িত্ব থেকে তিনি সরে দাঁড়াবেন। জাপান অলিম্পিক কমিটি এখন পরবর্তী সভাপতি ঠিক করে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।


২০২০ সালের সর্বশেষ কেলেঙ্কারির কেন্দ্রে আছেন জাপানের বিদায়ী অলিম্পিক মন্ত্রী ইয়োশিতাকা সাকুরাদা। ২০১১ সালের সুনামি ও ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পুনর্গঠন কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত বেফাঁস কিছু কথাবার্তা বলে দেওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে তাঁকে পড়তে হয় এবং প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে মন্ত্রিসভা থেকে তাঁকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হন। সাকুরাদার আগে অলিম্পিক মন্ত্রীর দায়িত্ব যিনি পালন করেছিলেন, প্রবীণ সেই রাজনীতিবিদ শুনইচি সুজুকিকে এখন আবারও অলিম্পিক মন্ত্রীর পদে ফিরিয়ে এনেছেন।


নানারকম কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও অলিম্পিকের প্রস্তুতি কিন্তু নির্ধারিত গতিতেই এগিয়ে চলেছে। অলিম্পিক কমিটি ইতিমধ্যে ২০২০ সালের মার্চ মাসে সমগ্র দেশজুড়ে অলিম্পিক মশাল দৌড় শুরু হওয়ার সময়সূচি ঘোষণা করেছে। ২৬ মার্চ ফুকুশিমা জেলা থেকে শুরু হওয়া মশাল দৌড় ১২১ দিন ধরে দেশের ৪৭টি জেলা ঘুরে ১০ জুলাই টোকিও এসে পৌঁছাবে এবং অলিম্পিকের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হওয়ার আগে ১৫দিন ধরে জাপানের রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করবে।
‘আশা আমাদের পথ আলোকিত করে’—এই স্লোগান নিয়ে মশাল দৌড়ে অলিম্পিকের মূল্যবোধ তুলে ধরার পাশাপাশি জাপানের ভূমিকম্প ও সুনামিবিধ্বস্ত এলাকার পুনর্গঠনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।