বাংলাদেশই প্রধান বিষয় আসামের ভোটে

বাঙালিদের গায়ে বাংলাদেশি তকমা লাগানো চলছেই আসামে। ভিড় বাড়ছে ট্রাইব্যুনালে। ছবি: প্রথম আলো
বাঙালিদের গায়ে বাংলাদেশি তকমা লাগানো চলছেই আসামে। ভিড় বাড়ছে ট্রাইব্যুনালে। ছবি: প্রথম আলো

নাগরিকত্ব সংশোধনী (ক্যাব) বা নাগরিক নিবন্ধনকরণের (এনআরসি) হাত ধরে ‘বাংলাদেশই ভারতের আসাম রাজ্যের ভোটে এবারও প্রধান বিষয়। রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাশাপাশি সুশীল সমাজও একমত, আসাম এখনো ভোটের প্রচারে ‘বাংলাদেশ’ থেকে বের হতে পারেনি। কারণ আসামের ভোটে নির্ণায়ক শক্তিই হচ্ছেন বাঙালিরা। আর বিজেপির হাত ধরে এবার বাঙালি ভোটকে দু-ভাগে ভাগ করার চেষ্টা প্রকট।

কংগ্রেসের চা–বাগান সংগঠনের নেতা ভগীরথ করণ। তাঁর সঙ্গে সম্প্রতি কথা হচ্ছিল আসামের রাজধানী গুয়াহাটির কংগ্রেস ভবনে। ভগীরথের আক্ষেপ, ‘রাজ্যে সমস্যার অন্ত নেই। অথচ, বাংলাদেশের বাইরে বের হতে পারলাম না।’ বাস্তবেই আসামে বেকারত্ব, উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, দুর্নীতির মতো ভোট রাজনীতির মুখরোচক বিষয় বা স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো গুরুতর বিষয় সরকার বা বিরোধী পক্ষের ভোটের বিষয়ই নয়। এমনকি, ফি বছর বন্যায় মানুষের পাশাপাশি বন্য পশুরাও প্রাণ হারাচ্ছে আসামে। বন্যা প্রতিরোধ নিয়েও ভোট প্রচারে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না কোনো পক্ষ। তাদের মূল বিষয়ই বাংলাদেশ।

একসময় আসামে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন বহু যুবক। স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন আসামের। গড়ে উঠেছিল সন্ত্রাসবাদী সংগঠন উলফা। সেই উলফার চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়ার মতে, আসামের ভিটেমাটি বেদখল হয়ে যাওয়াতেই তাঁরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। অভিযোগের তির তথাকথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের দিকে। উলফা ছাড়াও ‘বঙাল খেদার’ নামে বহু মানুষকে হত্যা করেছে বিভিন্ন খিলঞ্জিয়া (ভূমিপুত্র) সংগঠন। দশকের পর দশক ধরে কখনো সরবে, কখনো বা নীরবে চলছেই বাঙালি নির্যাতন।

শিলচরে বিশিষ্ট আইনজীবী সাধন পুরকায়স্থ বলছিলেন, ‘ক্যাব বা এনআরসি আসলে তো সেই বাংলাদেশি সন্দেহে ভারতীয়দের হয়রানির জাঁতাকল। বললেন, বাঙালি ভূমিপুত্রদের গায়েও চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশি তকমা। পোরা হচ্ছে বন্দিশালায়। ভোটারদের নামের পাশে সন্দেহ চিহ্ন এঁকে দিয়ে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে নাগরিকত্ব।’

খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এসে ভোটে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ক্যাব বাস্তবায়নের। ক্যাব তো আসলে বাংলাদেশি হিন্দুদেরই নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। কংগ্রেসও পাল্টা হিসেবে ক্যাব না দেওয়াকেই হাতিয়ার করেছে। রাহুল গান্ধীর সভাতেও তাই গুরুত্ব পায় অনুপ্রবেশ। নেতাদের দেখানো পথেই ভোটপ্রার্থীর লোকজন চারদিকে শুধু ক্যাব আর এনআরসি নিয়েই প্রচারে ব্যস্ত। আবার আক্ষেপও করছেন নেতারা। বিজেপিও বলছে, উন্নয়নই সবচেয়ে জরুরি। কিন্তু একান্তে তাদের মুখেও শোনা যাচ্ছে আসামে বাংলাদেশটাই বেশি চলে।

আগামী বৃহস্পতিবার আসামের বাংলাভাষী এলাকা বরাক উপত্যকায় ভোট। প্রচার তুঙ্গে। আজ সোমবার বাংলা নববর্ষ ভারতে। আজও প্রচারে কিন্তু বারবার উঠে এল সেই বাংলাদেশ। বরাক উপত্যকা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির নেতা তৈমুর রাজা চৌধুরী পয়লা বৈশাখ পালনেও টানলেন বাংলাদেশের উদাহরণ। প্রথম আলোকে তৈমুর বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো নববর্ষের অনুষ্ঠান জরুরি বরাকে। তাহলেই এক হবে সব বাঙালি।’

এবারের ভোটে বাঙালি জাতিকেই দুই টুকরো করার চেষ্টা চলছে বলে মনে করেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘এনআরসির কারণে বাঙালির দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। বাংলাদেশি-বাংলাদেশি বলে বাঙালি জাতিটাকেই শেষ করার চক্রান্ত চলছে। এখন প্রয়োজন বাঙালির একতা। না হলে ভারতের বাঙালিদের সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

কিন্তু তবু বিভাজনের রাজনীতি বেশ সক্রিয়। ভোট রাজনীতির স্বার্থে ভারতীয় বাঙালির বিশেষ বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের ভারতীয়, আর অন্যদের বাংলাদেশি বলার প্রয়াস দিন দিন বাড়ছে। এবারের ভোটে আরও প্রকট বাংলাদেশ। তাই সন্দেহের বশে ভোটাধিকার হারিয়েছেন ১ লাখ ২০ হাজার নাগরিক। বন্দিদশায় রয়েছেন হাজারখানেক। আরও ৭০ হাজারের সন্ধান চলছে। ৪০ লাখ আসামবাসীর নাগরিকত্বও বাংলাদেশি সন্দেহের তালিকায়। এঁদের সিংহভাগই বাঙালি। বংশানুক্রমে আসামে বাস করেও তাঁরা নিজেদের ‘নাগরিক’ করে তুলতে পারলেন না। তাই এবারও ভোটে সেই বাংলাদেশ আর বাংলাদেশিতেই আটকে আছে আসামে।