তাপস পালের সেই আসনে ত্রিমুখী লড়াই

মহুয়া মৈত্র, শান্তনু ঝাঁ ও কল্যাণ চৌবে। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
মহুয়া মৈত্র, শান্তনু ঝাঁ ও কল্যাণ চৌবে। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

বাংলা চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত অভিনেতা তাপস পালের ফেলে যাওয়া নির্বাচনী আসনটি এখন ত্রিমুখী লড়াইয়ে জমজমাট। ভারতের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর আসনটিতে তৃণমূল, বিজেপি ও সিপিএমের শক্ত প্রার্থীরা এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নানা হিসাব–নিকাশে কে জয়ী হতে পারেন, সে সম্পর্কে কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। প্রত্যেকেরই জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। আর হিসাব-নিকাশের জটিল সমীকরণে কংগ্রেসও আসনটিতে জয় পেতে আশাবাদী।

কৃষ্ণনগর আসনটিতে নির্বাচন হবে চতুর্থ দফায় ২৯ এপ্রিল। এই আসনের সঙ্গে অভিনেতা তাপস পালের নামটি খুব বেশি উঠে আসে। অভিনেতা থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া তাপস পাল নানা বিতর্কে দল থেকে, রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছেন। এখন একাকী জীবন কাটে তাঁর। একসময় তাপস পাল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। মমতা ২০০১ সালে চলচ্চিত্র অঙ্গন থেকে টেনে এনে তাঁরই দলের বিধায়ক করেছিলেন কলকাতার আলীপুর আসন থেকে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন এই আসনের দুবারের বিধায়ক।

২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মমতা তাপস পালকে মনোনয়ন দেন নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর আসনে। জয়ী হন তিনি। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই আসনে সিপিএম প্রার্থী অধ্যাপক শান্তনু ঝাঁকে হারিয়ে আবার জয়ী হন। এই জয়ের পর আবেগে আপ্লুত তাপস পাল নিজেকে উৎসর্গ করেন তৃণমূলের জন্য।

তবে এই আনন্দের মধ্যে নিরানন্দের ছবি ভেসে ওঠে তাপস পালের জীবনে। সাংসদ হওয়ার মাসখানেক পর ২০১৪ সালের জুন মাসে তাপস পাল নদীয়ার চৌমাহা গ্রামে দলীয় এক সভায় সিপিএমকে গালাগালি করতে গিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে বসেন। বলেন, ‘আমি অনেক মাস্তানি করেছি। রংবাজি করেছি। আমি চন্দননগরের ছেলে। আমি পকেটে মাল নিয়ে ঘুরি। আমি নিজে রিভলবার দিয়ে গুলি করে চলে যাব। সিপিএমকে গুলি করে মারব। আমার মা, বোন, বাবা, বাচ্চা—কারও গায়ে যদি হাত পড়ে, আমি ছেড়ে কথা বলব না। বাড়ি বাড়ি ঢুকে ছেলে পাঠিয়ে রেপ করে দেব। তৃণমূলের কারও গায়ে যদি সিপিএমের হাত পড়ে, তবে তাদের গোষ্ঠী শেষ করে দেব। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেব।’

এই বেফাঁস মন্তব্যের পর তাপস পালের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। দলের কাছে অভাজন হয়ে যান তাপস পাল। একলা হয়ে যান। দীর্ঘ পাঁচ বছর এভাবে একাকিত্ব জীবন কাটাতে থাকেন। এরই মধ্যে জড়িয়ে পড়েন স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প রোজভ্যালি দুর্নীতিকাণ্ডে। রোজভ্যালি থেকে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। মামলার তদন্তে নেমে ২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর সিবিআই গ্রেপ্তার করে তাপস পালকে। দীর্ঘ ১৩ মাস কারাজীবন কাটানোর পর অবশেষে উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামিন পান। কিন্তু দল আর তাঁকে গ্রহণ করেনি। তিনি ওই ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইলেও ক্ষমা করেননি মমতা বা দল তৃণমূল।

এবার এই কৃষ্ণনগর কেন্দ্রে আর মনোনয়ন পাননি তাপস পাল। এখন আর তাঁকে চলচ্চিত্রে তেমন দেখা যায় না। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, এবার তিনি যাত্রাপালায় অভিনয় করবেন।

তাপস পালের ফেলে যাওয়া কৃষ্ণনগর আসনে এবার জোর ত্রিমুখী লড়াইর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে বলছেন, এবার আর তাঁরা তৃণমূলকে ভোট দেবেন না। এই আসনের সাংসদ তাপস পাল যেভাবে দেশের নারীদের নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করেছেন, সেই দলকে আর এবার ভোট নয়। তবে আরেক পক্ষ বলেছে, মানুষ তো তাপস পালকে দেখে ভোট দেননি। ভোট দিয়েছেন মমতার উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড দেখে। এবারও কৃষ্ণনগরের মানুষ ভোট দেবেন তৃণমূলকেই। তবে বিজেপি ও বাম দলের প্রার্থীরা এই যুক্তি মানছেন না। তাঁরা দৃঢ়ভাবে বলেছেন, এবার আর তাপস পালের ভাবমূর্তি নেই এলাকায়; বরং দুর্নাম গোটা অঞ্চলে।

তৃণমূল এবার কৃষ্ণনগর আসনে মহুয়া মৈত্রকে প্রার্থী করেছেন। সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা মহুয়া নদীয়ার করিমপুরের বিধায়ক। ২০১৬ সালে ওই আসনে তিনি জয়ী হয়েছিলেন।

সিপিএম প্রার্থী করেছে ২০১৪ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী অধ্যাপক শান্তনু ঝাঁকে। শান্তনু ঝাঁরও একটা সুনাম রয়েছে এলাকাজুড়ে। তিনি মনে করেন, এবার এই কৃষ্ণনগরের মানুষ তাঁকে ফিরিয়ে দেবেন না। মানুষ এখন বিজেপি ও তৃণমূলের শাসন দেখে ফিরে যেতে চাইছে বাম দলের শাসনে।

বিজেপি এবার এই আসনে প্রার্থী করেছে প্রখ্যাত সাবেক ফুটবলার কল্যাণ চৌবেকে। কল্যাণ চৌবে ভারতের একজন নামী গোলরক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। খেলেছেন মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল ও সালগাঁওকার ফুটবল দলে। সাফ গেমসেও খেলেছেন।

আর কংগ্রেস এবার এই আসনে প্রার্থী করেছে অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারক ইন্তাজ আলী খানকে। তাঁরও এই এলাকায় সুনাম রয়েছে। কংগ্রেস মনে করে, ত্রিমুখী এই লড়াইয়ের মধ্যে কংগ্রেস প্রার্থীর জয়ের পথ খুলে যেতে পারে। যদিও কংগ্রেস দাবি করেছে, লড়াই হবে চতুর্মুখী।